বাল্যবিবাহ প্রবণতা রোধ করুন

7

যুগ যুগ ধরে বাল্যবিবাহ নামে একটি ব্যাধি বহন করে চলেছে সমাজ। বিশেষ করে কন্যা শিশুরাই বেশি শিকার হচ্ছে এই ব্যাধির। বাল্যবিবাহের ঝুঁকি নিয়ে গণসচেতনতা তৈরিতে নানামুখী প্রচার, স্কুলে মেয়েদের বহুমুখী প্রণোদনা এবং শাস্তিযোগ্য আইন প্রণয়ন করেও এই ব্যাধি থেকে মুক্তি মিলছে না। করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলে বাল্যবিবাহের চিত্রটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। খোলার পর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনগুলোতে ড্রপ আউটের যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, তার উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে বাল্যবিবাহ। সাতক্ষীরার একটি স্কুলে বাল্যবিবাহের কারণে ড্রপ আউট হয়ে গেছে ৫০ জন ছাত্রী। জেলা প্রশাসন এসব শিক্ষার্থী এবং বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে।
করোনাকালে একটি উপজেলায় বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে অন্তত ৬শ’ ছাত্রী। স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক অভিভাবকের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আয় কমে যাওয়ায় অনেক অভিভাবক তাদের কন্যা শিশুকে বোঝা মনে করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিয়টি প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গেছে। একটি উপজেলার চিত্র এমনটি হলে সারা দেশের চিত্র কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমান করা যায়। ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে ২৫ শতাংশ, যা গত ২৫ বছরে সর্বোচ্চ। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনা ছাড়াও বিশ্বে বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বাংলাদেশ অন্যতম। গত ৩০ বছর ধরে অবশ্য এই হার ধীরে ধীরে কমে আসছে।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের কারণ মূলত দারিদ্র্য। একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া কন্যা শিশুর অভিভাবক সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। পরিবারের দাদি-নানি কিংবা মুরব্বিদের শখের কারণেও অনেক শিশু বাল্যবিবাহের শিকারে পরিণত হয়। অনেক ক্ষেত্রে পড়ার বখাটে ছেলেদের উৎপাতেও অনেক অভিভাবক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান। বাল্যবিবাহের এই প্রথা নারীদের ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক মূল্যবোধ ও অবক্ষয়কে প্রতিফলিত করে। দারিদ্র্য ও অশিক্ষা এক্ষেত্রে নির্ধারণী বিষয়। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০ শতাংশের অধিক বাংলাদেশের নারীর ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের নিচে। দেশে এতদিন ১৯২৯ সালে প্রণীত একটি আইন অনুযায়ী বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রিত হতো। সময়ের চাহিদায় ২০১৭ সালে তা বাতিল করে প্রাণয়ন করা হয়েছে নতুন আইন। এই আইনে মেয়েদের বিয়ের বসয় সর্বনিম্ন ১৮ এবং ছেলেদের সর্বনিম্ন ২১ নির্ধারণ করা হয়। এই আইন ভঙ্গকারীর জন্য জেল জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে করোনা মহামারীর বিশেষ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট নানা ধরনের অনিশ্চতায় এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবারও কঠোরভাবে এর রাশ টেনে ধরতে হবে। সে জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক এবং মসজিদের ইমামদের এগিয়ে আসতে হবে।