সরকারে পদ-পদবি নিয়ে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে তালেবান ॥ বহু নেতা নাখোশ, বরাদর নিখোঁজ

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কট্টর ইসলামপন্থী সংগঠন তালেবানের কাবুল দখলের একমাস না যেতেই সংগঠনটির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের খবর পাওয়া গেছে। নয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পদ-পদবি নিয়ে তালেবানের প্রথম সারির বহু নেতা বেজায় নাখোশ। সরকার ঘোষণার পরপরই কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে নেতারা একে অন্যের ওপর চড়াও হন। তালেবানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমানে সংগঠনটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা আবদুল গনি বরাদরের সঙ্গে মধ্যমসারির একমন্ত্রী প্রকাশ্য বিতন্ডায় জড়ান। বরাদরের মৃত্যুর খবর প্রকাশ পায়। পরে তালেবান নেতারা খবরটি অস্বীকার করেন। বুধবার এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ওই বিতন্ডার পর থেকেই নিখোঁজ বরাদর। একরাশ অভিমান নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছাড়েন তিনি। অপর এক গণমাধ্যম দাবি করেছে, কাবুল ছেড়ে কান্দাহার চলে গেছেন এই নেতা। সেখানে ভাল আছেন। অবশ্য এ বিষয়ে তালেবান কর্তৃপক্ষের কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধ চলছে বলে বেশ কিছুদিন ধরেই খবর পাওয়া যাচ্ছিল। যদিও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে জনসমক্ষে দেখা যায়নি বরাদরকে। তবে তালেবান কর্মকর্তারা বরাবরই এসব তথ্য নাকচ করে আসছিলেন। ১৫ আগষ্ট তালেবান আফগানিস্তান কব্জা করে দেশটিকে ইসলামিক আমিরাত বলে ঘোষণা দেয়। সংগঠনটি যে সরকার ঘোষণা করেছে, সেখানে সবাই পুরুষ। সরকারে সংগঠনটির সিনিয়র নেতারা ঠাঁই পান। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে গত দুই দশক ধরে মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সব হামলার অভিযোগ রয়েছে। তালেবানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র বলেছে, বরাদর এবং শরণার্থী বিষয়ক মন্ত্রী খলিল উর-রহমান হাক্কানির মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য বিনিময় হয়। তখন সেখানে থাকা তাদের অনুসারীরাও পরস্পরের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। খলিল উর-রহমান হাক্কানি আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাতার-ভিত্তিক একজন জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতা নিশ্চিত করেছেন যে, গত সপ্তাহেও একবার তর্কবিতর্কের সূচনা হয়। সূত্র জানিয়েছে, সেখানে বিতণ্ডা তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, নয়া সরকার নিয়ে বরাদর সন্তুষ্ট নন। আফগানিস্তান জয়ের কৃতিত্ব নিয়েও তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্কের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। আবদুল গনি বরাদর মনে করেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়েছেন, কৃতিত্ব তাদের। তবে তালেবানের অন্যতম জ্যেষ্ঠ একজন নেতা পরিচালিত হাক্কানি নেটওয়ার্কের মত, যুদ্ধের মাধ্যমে তারা এই বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। প্রথম তালেবান নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন বরাদর। ২০২০ সালে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার চুক্তিতে তালেবানের পক্ষে তিনি স্বাক্ষর করেন।
সেই সময় আফগান বাহিনী ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাক্কানি নেটওয়ার্ক সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ কিছু হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। এই গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী সংগঠন বলে তালিকাভুক্ত করেছে। তালেবান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। তালেবানের এক মুখপাত্র দাবি করেছেন, সুপ্রীম লিডার হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার সঙ্গে দেখা করতে কান্দাহার গেছেন বরাদর। তিনি ক্লান্ত। কান্দাহারে কিছুদিন বিশ্রামের পর তিনি কাবুল ফিরবেন। অনেক আফগান মনে করেন, তালেবানের বক্তব্য নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ ২০১৫ সালে এই গ্রুপটি স্বীকার করেছিল যে, তাদের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর খবর দুই বছর পর্যন্ত গোপন করে রাখা হয়েছিল।
পাক-তালেবান বাণিজ্য বৃদ্ধি : তালেবান আফগানিস্তান দখলের পর দেশটির বড় শহরগুলোতে বাণিজ্য বন্ধ ছিল। প্রায় ১৯ দিন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকার পর পাক রফতানিকারকরা আফগানিস্তানে পণ্য রফতানি ফের শুরু করেছে। আফগান ব্যবসায়ী আব্দুল রহিম কাজিযাই বলেন, তালেবান যখন বড় শহরগুলো দখল করে তখন অবস্থা খারাপ হতে পারে ভেবে আমি পাকিস্তানে কোন পণ্যের অর্ডার করিনি। কিন্তু এখন আমি পাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিনি এবং রান্নার তেলের অর্ডার করেছি। বুধবার খাইবার পাস এলাকায় শত শত ট্রাক অপেক্ষারত অবস্থায় দেখা গেছে। খাদ্যপণ্যে ভর্তি ট্রাকগুলো জালালাবাদে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। আফগান সাইডে পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় ড্রাইভারদের তিন-চার দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সারি দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত দেয়। আফগানিস্তান কপার, সোনা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম, বক্সাইট, কয়লা, লোহা, জিপসাম, জিঙ্ক , জেমস্টোনসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ। কিন্তু ২০ বছর ধরে দেশটিতে যুদ্ধ থাকায় এগুলো অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। তোরখাম বর্ডারে পাকিস্তানের একজন কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তে গত কয়েক দিন ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আগস্টের শুরুতে আমরা লক্ষ্য করছিলাম সবজি, ফল, আনার পর আফগান ট্রাকগুলো খালি যাচ্ছে। কিন্তু এখন সেগুলো পাকিস্তান থেকে পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা ট্রাকগুলো পারাপার হতে সহযোগিতা করছি।