সব খুলছে আজ, সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের ॥ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র ও গণজমায়েতের ওপর বিধিনিষেধ থেকেই যাচ্ছে ॥ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে না মানলে সামনে বড় বিপদ

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ শেষে আজ বুধবার দেশের সব কিছু খুলে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক ও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশনা মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পর্যটন বিনোদনকেন্দ্র ও গণজমায়েত ছাড়া সব কিছুই চলবে। করোনা সংক্রমণের হার গত সপ্তাহের তুলনায় কিছুটা নিম্নমুখী হলেও মৃত্যু বেড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে হলেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার অফিস আদালত, গণপরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সব কিছু সচল হলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে জনগণকে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনীতি সচল রাখতে সব কিছু খুলে দেয়ায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। তবে জনগণ সচেতন হলে এই হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নইলে সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করবে।
রবিবার মন্ত্রিপরিষদ থেকে জারি করা সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুসারে আজ বুধবার থেকে অফিস-আদালত, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, শপিংমল, দোকানপাট, গণপরিবহন, লঞ্চ, ট্রেন-সব চালু হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১ আগষ্ট থেকে সব ধরনের রফতানিমুখী কলকারখানা চালু করা হয়েছে। বুধবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিনোদন কেন্দ্র ছাড়া সব কিছুই চলবে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু হবে পুরোদমে। এর মধ্য দিয়ে গত দেড় বছর ধরে থেমে থেমে লকডাউন ও বিধিনিষেধের পর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করে তুলবে সরকার। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। গণপরিবহন চালানোর নির্দেশনা নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরেই সমালোচনা তৈরি হয়েছে। বিধিনিষেধ পুরোপুরি তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার কিছুটা নিম্নমুখী অবস্থানে রয়েছে। সোমবার নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ছিল ২৪.২৮ শতাংশ। রবিবার ছিল ২৪.৫২ শতাংশ, শনিবার এই হার ছিল ২৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ শুক্রবার হার ছিল ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, বৃহস্পতিবার ছিল ২৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। প্রতিদিনই নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে শনাক্তের হার কিছুটা কমছে। আগের সপ্তাহে বেশিরভাগ দিনই করোনা শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করেছিল। সেই হিসেবে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা কমেছে।
গত সাত দিনে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও জটিল রোগীর সংখ্যা বাড়ায় মৃত্যু বেড়েছে। বিগত সাত দিনে দেশে মোট ১৯৮১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। সোমবার দেশে ২৪৫ জন, রবিবার ২৪১, শনিবার ২৬১, শুক্রবার ২৪৮, বৃহস্পতিবার ২৬৪, বুধবার ২৪১, মঙ্গলবার ২৩৫ ও সোমবার ২৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে করোনায় প্রথম মৃত্যুর পর মোট ২২ হাজার ৮৯৭ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে গত সাতদিনে মোট মৃত্যুর ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ মৃত্যু ঘটেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডাঃ নজরুল ইসলাম বলেন, উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে সব কিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। এতে সংক্রমণ আরও বাড়বে। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি টিকাকরণ, অপরটি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। দেশে দ্রুততম সময়ে টিকাকরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ যে পরিমাণ টিকা আসছে তা দিয়ে সব মানুষের টিকা নিশ্চিত করতে দেড় থেকে দুই বছর লাগবে। এর আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার ওপরই অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর এ বিষয়ে যে পরামর্শ দিয়েছিল, তাও আমলে নেয়া হয়নি। এরপরও সরকারের প্রতি আহ্বান- বিধিনিষেধ তুলে দেয়ার আগে আরও ভাবুন।
ঈদুল আযহার পর আগের কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের ১৯ দিন পর আজ বুধবার থেকে সারাদেশের দোকানপাট ও বিপণিবিতান খুলছে। তবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করতে হবে। সরকার পরবর্তী নির্দেশ দেয়া না পর্যন্ত দোকানপাট ও বিপণী বিতান সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টা খোলা থাকবে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন মঙ্গলবার বলেন, কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট ও বিপণিবিতান খুলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে গত ২৮ জুন থেকে সীমিত আকারে বিধিনিষেধ শুরু হয়। সেদিন থেকেই সারাদেশের দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। ঈদের আগে আট দিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করে সরকার। তাতে ঈদের আগে ছয় দিন বেচাকেনার সুযোগ পান ব্যবসায়ীরা। অনেকে ঈদের দিন ও তার পরদিনও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলা রাখেন। ২৩ জুলাই থেকে আবার ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। পরে সেটি মঙ্গলবার পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
আজ বুধবার থেকে শতভাগ আসনে যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চলাচল করবে। একই সঙ্গে লঞ্চের বাড়তি ভাড়া প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজ বুধবার থেকে শতভাগ আসনে যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চলবে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে লঞ্চের ভাড়া বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাই নতুন করে লঞ্চের ভাড়া বাড়ছে না বলেও জানান তিনি।
যেভাবে চলবে গণপরিবহন : আজ বুধবার থেকে সারাদেশে চলবে গণপরিবহন। করোনাকালীন নির্ধারণ করা ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করে আগের স্বাভাবিক ভাড়ায় সব গণপরিবহন চলাচল করবে। তবে কোন পরিবহন দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করতে পারবে না। এমন নির্দেশনা দিয়ে গণপরিবহন চলাচলের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএর বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, আসন সংখ্যার অতিরিক্ত কোন যাত্রী পরিবহন করা যাবে না এবং দাঁড়িয়ে কোন যাত্রী বহন করা যাবে না। সড়ক পথে গণপরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন (সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক) নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংশ্লিষ্ট দফতর/ সংস্থা, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিদিন মোট পরিবহন সংখ্যার অর্ধেক চালু করতে পারবে। আগের ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া কোনভাবেই আদায় করা যাবে না। এছাড়া গণপরিবহনের যাত্রী, চালক, সুপারভাইজার/কন্ডাক্টর, হেলপার-কাম ক্লিনার এবং টিকিট বিক্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাত্রার শুরু ও শেষে যানবাহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নসহ জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এছাড়া যাত্রীদের হাতব্যাগ, মালপত্র জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা যানবাহনের মালিকদের করতে হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের শেষ দিন মঙ্গলবার রাস্তায় নেই শুধু গণপরিবহন, আর বিপণিবিতান বন্ধ রয়েছে। এছাড়া মঙ্গলবার রাজধানীর কোন রাস্তা দেখলে বোঝার উপায় নেই যে কঠোর বিধিনিষেধ এখনও আছে। বিধিনিষেধ শিথিলের একদিন আগেই প্রায় সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি, পণ্যবাহী গাড়ি, সরকারী যানবাহন আর রিক্সা-ভ্যানে রাজধানী যে চেহারা পেয়েছে, তা দেখে মনে হচ্ছে একদিন আগেই সব খোলা রয়েছে।