করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের, জ্যামিতিক হারে ছড়িয়ে পড়বে সংক্রমণ

1

কাজিরবাজার ডেস্ক :
চলমান কঠোর বিধিনিষেধেরই সুফল মেলেনি। কঠোর বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সংক্রমণ ও মৃত্যুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই। একটি আইসিইউ বেডের জন্য ৪০ জন গুরুতর করোনা রোগীকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এরই মধ্যে শিল্প কারখানা খুলে দেয়ায় গ্রোতের মতো মানুষ ঢুকছে ঢাকায়। যেখানে মাস্ক কিংবা সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। ফলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই আশঙ্কায় উদগ্রীব বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই অর্থনীতি সচল রাখতে কল-কারখানা চালু করায় আগামীতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে জ্যামিতিক হারে। শ্রমিকদের ঢলে করোনা সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ডকেই ছাড়িয়ে যাবে। তাই আগস্ট মাসে করোনার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে দেশের মানুষের সামনে। বিধিনিষেধের শিথিলতা ও কঠোর বিধিনিষেধ শেষ না হতেই কল-কারখানা চালুতে ভয়াবহ আগস্ট আসছে বাংলাদেশে।
সরকারের কোভিড বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সভাপতি প্রফেসর মু. শহীদুল্লাহ বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের হার অতি উচ্চ। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে আজ রবিবার থেকে রফতানিমুখী শিল্প কারখানা করোনা ঝুঁকি আরও বাড়াবে। আগামী দিনগুলোতে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ জুলাই কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর দিনে করোনায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬৩৬৪ জন। এছাড়া ২৪ জুলাই করোনায় ৬৭৮০ জন, ২৫ জুলাই ১১২৯১ জন, ২৬ জুলাই ১৫১৯২ জন, ২৭ জুলাই ১৪৯২৫ জন, ২৮ জুলাই ১৬২৩০ জন ও ২৯ জুলাই ১৫২৭১ জন রোগী নতুন শনাক্ত হয়েছেন, ৩০ জুলাই ১৩৮৬২ জন।
গত ২৩ জুলাই করোনায় মারা গেছেন ১৬৬ জন। পরদিন ২৪ জুলাই ১৯৫ জন, ২৫ জুলাই ২২৮ জন, ২৬ জুলাই ২৪৭ জন, ২৭ জুলাই ২৫৮ জন, ২৮ জুলাই ২৩৭ জন ও ২৯ জুলাই ২৩৯ জন করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। ৩০ জুলাই মারা গেছে ২১২ জন।
গত এক সপ্তাহে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ডের মধ্যেই সরকার কলকারখানা চালুর ঝুঁকি নিল। যদিও গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ৫ আগষ্টের আগে কারখানা খোলা হবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার কলকারখানা খুলে দিতে বাধ্য হলো।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ঊর্ধ্বগতিতে চলতি মাসের শুরুতে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। পরে ঈদুল আযহার আগে ১৫ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। ১৫ জুলাই বলা হয়েছিল, ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগষ্ট পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনিষেধ চলবে। কোন কলকারখানা খোলা থাকবে না। সবচেয়ে কঠোর কর্মসূচী হিসেবে এটি পালিত হবে। সেই কারণে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে গিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। প্রাইভেটকারে, মাইক্রোবাসে, লঞ্চে কিংবা ফেরিতে গাদাগাদি করে গ্রামে গিয়েছেন ঈদ উদযাপন করতে। আবার ঈদের পরের কয়েকদিনে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই একভাবে ঢাকায় ফিরেছে মানুষ। যা ঢাকার বাইরে ছিল কিন্তু আজ রবিবার থেকে কলকারখানা খোলার ঘোষণায় ফের ঝুঁকি নিয়েই ঢাকায় আসছে সবাই।
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে কল-কারখানা খোলার বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, যারা শুধু ঢাকায় আছেন তাদের নিয়েই কারখানার কর্মকান্ড শুরু করা হবে। যারা ঢাকার বাইরে তারা কেউ চাকরি হারাবে না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, রফতানিমুখী যে শিল্প কলকারখানাগুলো আছে সেগুলো আজ থেকে খুলে দেয়া হবে। শুধু যারা ঢাকাতে আছে, কারখানার আশপাশে যারা রয়ে গেছে, তাদের নিয়ে তারা কাজগুলো করবে ৫ তারিখ পর্যন্ত। আমরা এর ভেতরে সিদ্ধান্ত নেব ৫ তারিখের পর কী হবে।
গত ১৪ জুলাইয়ে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল ঘোষণার পরেই কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা বলছেন, এই শিথিলতার পক্ষে তারা ছিলেন না। তারা বলছেন, সরকারের শিথিল বিধিনিষেধের এ ঘোষণা তাদের পরামর্শের উল্টো চিত্র। এ সময় এ ধরনের শিথিলতা বিধিনিষেধ তুলে নেয়ারই শামিল। সেটিরই ফল এখন ঘটছে। কলকারখানা খুলে দেয়ার ভয়ঙ্কর ফলও সামনে পাওয়া যাবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিল, স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভিড় এড়িয়ে চলার কথা বলছে, সেখানে সংক্রমণের ‘পিক টাইম’ কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বিশেষ করে কোরবানিতে গরুর হাটে গাদাগাদিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়ছে প্রতিদিনই।
এখন সব সময়ের চেয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এর মধ্যেই পোশাক কারখানা খুলে দিল সরকার। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং তৈরি পোশাক খাতের ক্রেতা ধরে রাখতে কারখানা চালু করা হচ্ছে। ঈদের পরও যেসব পোশাক কর্মী গ্রামে অবস্থান করছিলেন এমন খবরে তারা এরই মধ্যে ঢাকায় আসতে শুরু করেছেন। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা পিকআপ, ট্রাক ও ইঞ্জিনচালিত ভ্যান ও রিক্সায় বাড়ি থেকে রওনা হয়েছেন।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চলমান কঠোর বিধি নিষেধ আরও বাড়াতে চেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম জানিয়েছেন, তারা চান বিধিনিষেধ ‘কন্টিনিউ’ হোক। যদিও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, চলমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সুপারিশ এটা কনটিনিউ করার। কেবল অতি জরুরী সেবা ছাড়া যেভাবেই হোক সবকিছু সীমিত রাখতে হবে। এগুলো মনিটর করতে হবে। সব খুলে দিলে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাবে, অবশ্যই বেড়ে যাবে।
গত ২৫ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন সেন্টারে ফিল্ড হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, যেভাবে রোগী বাড়ছে, হাসপাতালে বেড সঙ্কট দেখা দিতে পারে। দেশে ঈদ-উল-আজহার ছুটিতে গ্রামে যাওয়া আসার কারণে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় গুণ। এছাড়া শহরের হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীর ৭৫ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা। এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে হাসপাতালে রোগীদের শয্যা দেয়া যাবে না বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঈদের সময়ের শিথিল বিধিনিষেধের নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে আরও দুই সপ্তাহ পর। এখন যে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি এবং মৃত্যু সংখ্যা দেখা যাচ্ছে সেটা আগের শিথিল লকডাউনের প্রভাব।
করোনা ডেল্টা ধরনের কারণে দ্রুত সংক্রমণ এভাবে বাড়তে থাকলে আগষ্ট মাস পর্যন্ত অবস্থা আরও খারাপ হবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, কঠোর বিধিনিষেধ সঠিকভাবে পালিত হলে ভাল সুফল আগস্টের শেষের দিকে পাব। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোর একটা ধারণ ক্ষমতা রয়েছে, প্রতিদিন এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে হাসপাতাল আর চাপ নিতে পারবে না। হাসপাতালের সক্ষমতা রয়েছে ১৫ হাজার শয্যার মতো, কিন্তু আর কত বাড়ানো যাবে, কিন্তু ১৫ হাজারের বেশি রোগী হতে বেশি সময় লাগবে না। যে হারে সংক্রমণ চলছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হবে। এখন যে ‘খারাপ পরিস্থিতিটা’ হচ্ছে তা দুই সপ্তাহ আগের পরিস্থিতি আর মৃত্যু যেটা হচ্ছে সেটা তিন সপ্তাহ আগের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মহামারী বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, ঈদের আগে যে এক সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল ছিল তার প্রভাব দেখা যাবে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবকদের স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তার মতে, মেডিক্যাল শিক্ষার্থী-নার্সিং শিক্ষার্থী-মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের ভলান্টিয়ার করা যায়। তারা জনস্বাস্থ্যবিদ, বিশেষজ্ঞ এ্যানিস্থেসিওলজিস্টদের পরামর্শ মেনে কাজ করবেন। তাদের যদি কাজে লাগানো না হয়, তাহলে সামাল দেয়া যাবে না। এগুলো না করা গেলে আত্মরক্ষাও হবে না।
‘যে সময়ের লকডাউনই ধরি না কেন, লকডাউন তো হয় নাই’ মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ এ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এর প্রভাব দেখতেই পাচ্ছি। সংক্রমণ বাড়ছে-মৃত্যুও হচ্ছেই। মানুষকে ঈদের ভেতরে ছেড়ে দেয়ার খেসারত দিতে হবে সামনে মন্তব্য করে আবু জামিল ফয়সাল বলেন, আর এটা যে কতদিন পর্যন্ত দিতে হবে কেউ জানে না।