চাঞ্চল্যকর শতাধিক খুনের মামলা হিমাগারে ॥ আসামিদের কাঠগড়ায় আনা যাচ্ছে না

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশের শতাধিক চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তের ভাগ্য চলে গেছে হিমাগারে। এক যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি-এমন হত্যা মামলার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। খুন হয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়িক, রাজনীতিক, শোবিজের মডেল, ছাত্রছাত্রী, মুক্তমনা ব্লাগারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজন। খুনের রহস্য উদ্ঘাটনতো দূরের কথা খুনের ক্লু পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এসব খুনের মামলা তদন্ত কার্যত চলে গেছে হিমাগারে চলে যাওয়ায় খুনের আসামিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাচ্ছে না। এই ধরনের ব্যর্থতার কারণে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে- এমন অভিযোগ নিয়ে পরিবার-পরিজন বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কোন প্রতিকার নেই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছড়িয়ে পড়ায় সরকারের লাকডাউন কার্যকরসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ব্যাপক তৎপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সারাদেশের চাঞ্চল্যকর খুনের মামলাগুলোর তদন্ত করছে পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ। বছরের পর বছর ধরে তদন্তাধীন কোন কোন খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন করা হয়েছে এক ডজনেরও বেশিবার। আদালতের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য সময় চেয়েছে ৮০ বারেরও বেশি। খুনের মামলাগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে না, ক্ল খুঁজে বের করার উদ্যোগে ভাটা। চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তেরই যখন এই অবস্থা তখন অন্যান্য খুনের মামলার তদন্তের হাল কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে অপরাধ বিশেষজ্ঞ মহল।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ক্লুলেস খুনের ঘটনাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে বার বার। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে গেছে। আবার কিছু কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা প্রকৃত আসামিদের বাঁচানোর জন্য তদন্তের গতি কমিয়ে রহস্যের জালে আটকে দেয়া হয়েছে। কোন কোন ঘটনায় খুনীরা এতই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ধুর্ত যে- খুনের ঘটনা এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে, আসলেই ক্লুলেস (সূত্রবিহীন) করে রাখা হয়েছে। এসব ক্লুলেস খুনের ঘটনা তদন্তের এক পর্যায়ে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। আবার এমনও হয়েছে যিনি একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা তদন্ত করছেন তার কাঁধে আরও একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা চাপিয়ে দেয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা আর কূল-কিনারা করতে পারছেন না বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ বাসায় অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে মারা যান গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে তমোহর ইসলাম। কিন্তু এই খুনের ঘটনার রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। মিরহাজীরবাগে ২০০৮ সালের নবেম্বরে পরিবহন ব্যবসায়ী জুয়েল হোসেন ও তার বন্ধু পোশাক ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন টুটুল খুন হন। রহস্যজনক এ জোড়া খুনের তদন্তে ১০ বার কর্মকর্তা বদল করা হয়। কিন্তু রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরের মধ্যে সাংবাদিক সাগর-রুনী, জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে অজ্ঞাত মহিলা হত্যার রহস্য এখনও অনুদ্ঘাটিত। এ চাঞ্চল্যকর অন্তত শতাধিক হত্যা মামলার তদন্ত বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু খুন রহস্যের কোন কূল-কিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তের তদারকি করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ চাঞ্চল্যকর এসব হত্যা মামলার তদন্ত করছে। যেসব চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- রাজধানীর টিকাটুলির সিক্স মার্ডার, মোহাম্মদপুরের শিক্ষিকা হত্যাকা-, পরিবাগের তুর্কি এ্যাসোসিয়েটস অফিসে রমজান আলী খুন, এডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু হত্যাকান্ডের ঘটনা, মালিবাগে সানরাইজ হোটেলের ভেতর ডিবি ইন্সপেক্টর নুরুল আলম শিকদার ও এসআই আলমগীর হোসেন তালুকদার, পুরান ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার আহম্মদ হোসেন হত্যা, মিরপুরে ব্যবসায়ী আফতাব, প্রিন্স গ্রুপের মালিক কাজী শহিদুল হক, ওয়ার্ড কমিশনার মিস্টার, গুলশানে গৃহবধূ তাসমির হোসেন মুন্নী, পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী আজগর, খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী ইসলাম শিকদার, বিজয়নগরে ব্যবসায়ী নজরুল, সবুজবাগে আজিজুল, মিরপুরে আওয়ামী লীগ নেতা সামাদ খান, মিরপুরে মিসুক সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সান্টু, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মনু, ফকিরাপুলে ব্যবসায়ী সোহেল হোসেন টিটু, তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান ও মিরপুরের কাপড় ব্যবসায়ী আলী আকবর, জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সংস্থার মহাসচিব ইদ্রিস আলী বেপারি, বাড্ডায় থাই এ্যালুমিনিয়ামের ঠিকাদার আল আমিন, পুরান ঢাকার মহানগর পুস্তক বাঁধাই সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদ, মতিঝিলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাউসার আলী, ধানমন্ডির জিগাতলায় বিএনপির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান শিবলী, মোহাম্মদপুরে আবাসন কোম্পানি শেলটেকের কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ, রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা, রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ধানমন্ডিতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সবচেয়ে বেশি আলোচিত চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্ত হিমাগারে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার মধ্যে রাজধানী ঢাকার রাজাবাজারে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, খুলনায় তৈয়েবুর রহমান ও তার ছেলে মনির ও উত্তরায় জঙ্গী সংগঠন থেকে ফিরে আসা ফল ব্যবসায়ী মাসুম হত্যার ঘটনা এবং সাংবাদিক সাগর-রুনী দম্পতির। ২০২১ সালে এসে চলতি বছর পর্যন্ত সাগর-রুনি হত্যার নয় বছরে তদন্ত কর্মকর্তা সময় নিয়েছে ৭৮ বার। এরপরও সুরাহা হয়নি।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ড ঘটেছিল ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে পেরিয়ে গেছে নয় বছর। কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি নেই। মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় তদন্ত শেষ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তবে নয় বছর পেরিয়ে একাধিক সংস্থার হাত বদলেও দাখিল হয়নি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে এরইমধ্যে আদালত থেকে ৭৮ বার সময় নেয়া হয়েছে। সবশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। সেদিন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী আগাম১১ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের নতুন দিন ধার্য করেন। সবশেষ গত বছরের ৩ মার্চ তদন্ত কর্মকর্তা হাইকোর্টে দাখিল করা অগ্রগতির প্রতিবেদনে বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের ঘটনায় দু’জন অপরিচিত ব্যক্তি জড়িত ছিল। সাগরের হাতে বাঁধা চাদর ও রুনির টি-শার্টে ওই দুই ব্যক্তির ডিএনএ’র প্রমাণ মিলেছে। অপরাধীদের শনাক্ত করতে ডিএনএ প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি ল্যাব যথাক্রমে ইন্ডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস ও প্যারাবন স্ন্যাপশট ল্যাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বর্তমানে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠান দু’টি ডিএনএ’র মাধ্যমে অপরাধীর ছবি বা অবয়ব প্রস্তুতের প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে। তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব সদর দফতরের সহকারী পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমের সঙ্গে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার এক কর্মকর্তা। ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মোঃ রবিউল আলমের ওপর। দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব)। সেই থেকে নয় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি।
দীর্ঘ এ সময়েও তদন্ত শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মনির। তিনি আদালত পাড়ার সাংবাদিকদের বলেন, নয় বছর হয়ে গেল এখনও সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। মামলার তারিখ আসে আর যায়। কোন কাজ হয় না। উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে র‌্যাবকে একটা সময় বেঁধে দিক। র‌্যাব যদি রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারে তাহলে ব্যর্থতা স্বীকার করে মামলা ছেড়ে দিক। অন্য কোন সংস্থা ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করবে। সালেহা মনির বলেন, সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। কবরের পাশে গিয়ে কী বলব, বিচার হচ্ছে না। তবে বিচার একদিন হবেই। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, আমার শেষ নিশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমি সাগর-রুনি হত্যার বিচার চেয়ে যাব। দুনিয়ার বিচার না হলেও উপরে যিনি আছেন তিনি অবশ্যই বিচার করবেন।
রাজধানীর কলাবাগানে প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও চাঞ্চল্যকর ও নৃশংসভাবে খুনের শিকার চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান ওরফে লিপির ঘটনা। দীর্ঘ এই সময় তার কাছে স্বজন, ভাড়াটিয়া এবং প্রযুক্তির সহযোগিতা নেয়া হলেও এখনও পর্যন্ত খুনের কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। তবে সবধরনের ক্লু বিবেচনায় রেখে মামলার তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলাবাগান থানার পুলিশ। কি কারণে বা কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, এ বিষয়ে একাধিকবার তার স্বজদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে হত্যার সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনা নিশ্চিত হতে আমরা তদন্তে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করছি। সেক্ষেত্রে অবশ্যই এ ঘটনার প্রকৃত কারণ এবং দায়ীদের বের করে নিয়ে আসতে পারব বলে পুলিশের দাবি। উল্লেখ্য, গত ৩১ মে কলাবাগান প্রথম লেনের ৫০/১ বাসার ফ্ল্যাট থেকে ওই চিকিৎসকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে হত্যা করা হয় ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে। এই মামলারও তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। অপরাধীরা এখনও চিহ্নিত হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে এপর্যন্ত ২৩ বার সময় নিয়েছে সিআইডি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর হত্যার মধ্যে কয়েকটি মামলা ঝুলে আছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। পাঁচ বছরেও হত্যাকান্ডের মোটিভই উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি এমন মামলাও আছে। তদন্ত চলছে, শীঘ্রই অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে, এমন কিছু বক্তব্য দিয়েই পুলিশের তদন্ত সংস্থা দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যেসব হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি তার মধ্যে ২০০৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ২০০৫ সালে তেজগাঁওয়ে এডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু, ধানমন্ডিতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ হত্যাকান্ড ঘটে ২০০৬ সালে ও রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা খুন হন ২০০২ সালে। এসব খুনের ঘটনা এখনও অনুদ্ঘাটিত।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মামলার বাদী ও সাক্ষীরা তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদের কাছে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা না দিলে মামলার চার্জশীট দিতে বিলম্ব করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তা ছাড়া মামলা প্রত্যাহার করতে বাদীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। মামলার ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান বাদীরা। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকান্ডের মূল আসামিদের বাদ দিয়ে নিরপরাধীদের আসামি করে চার্জশীট দেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর ভাগ্য ঝুলে আছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির হাতে। অগ্রগতি নেই বেশিরভাগ মামলার তদন্তে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাঞ্চল্যকর মামলাসংক্রান্ত বৈঠক হচ্ছে না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের অদক্ষতা ও অজ্ঞাত কারণে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য অনুদ্ঘাটিত রয়ে যাচ্ছে। আসামিরাও চিহ্নিত হচ্ছে না। বিচার পাচ্ছেন না নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তবে খুনীরা এমন কিছু আলামত রেখে যায় তাতে খুনীদের শনাক্ত করা খুব সহজ। প্রযুক্তির ব্যবহার করে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে এমন দক্ষতা পুলিশের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। পুলিশের দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নেয়া দরকার। অন্যথায় পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন হারিয়ে যাবে।
পুুলিশ সদর দফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, মনিটরিং সেলে যেসব মামলা রয়েছে সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে যেসব মামলা আছে সেখানেও একই অবস্থা। কয়েকটি হত্যা মামলার সঙ্গে সরকারদলীয় এমপি, সন্ত্রাসী, নেতা-কর্মী জড়িত থাকায় ও তদন্তে সরকারদলীয় প্রভাব এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণেও বেশ কিছু মামলার তদন্ত চলে গেছে হিমাগারে।
সগিরা হত্যাকান্ড বা এসপির স্ত্রী মিতু হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা গেলে অন্যান্য চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করা যাবে না কেন। যেমন সগিরা হত্যাকান্ডের ৩০ বছর পর চার্জশীট দিয়েছে পিবিআই। এটা যেমন আশা জাগায় তেমনি প্রশ্নও তৈরি হয়। সেই প্রশ্ন সাগর-রুনি, তনু, মিতুসহ আরো অনেক হত্যাকান্ড নিয়ে।
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রিক্সায় করে ভিকারুননিসা স্কুল থেকে তার সন্তানকে আনতে যাওয়ার পথে সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল এটা ছিনতাইকারীদের কাজ। রমনা থানায় দায়ের করা মামলায় আসামিও ছিল অজ্ঞাত। কিন্তু তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ থেমে যায়। আদালতের মাধ্যমেও তদন্ত আটকে দেয়া হয়। পুলিশের নানা তদন্ত সংস্থার ‘ব্যর্থতার’ পর ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তারা অবশেষে ১৮০ দিনের মধ্যেই আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার ও চার্জশীট দিয়েছে। আর এই হত্যাকান্ডের মূলে রয়েছে পারিবারিক বিরোধ। ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে পুলিশের তখনকার এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুতে। বহুল আলোচিত এই হত্যাকান্ডের তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দিয়েছে পিবিআই। এসপি বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে বিদায় করাসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন বাবুল আক্তার কারাবন্দী।