চামড়া পাচার রোধে সীমান্তে সতর্কতা ॥ বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কোরবানির পশুর চামড়া ভারতে পাচার রোধে দেশের সীমান্তে সতর্কতা জারি করেছে প্রশাসন। সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে সীমান্ত জেলার পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে। সীমান্তবর্তী জেলায় নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। চামড়া পাচার করতে অর্ধশতাধিক চক্র সক্রিয়। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলার প্রশাসনকে সভা করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। দেশে চামড়ার দাম কম হওয়ায় এবং তুলনামূলক ভারতে চামড়ার দাম বেশি পাওয়ার আশায় চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছরই কোরবানির সময়টিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৮৪ কিলোমিটার সীমান্তের কমপক্ষে ১১টি চোরাচালান পয়েন্ট দিয়ে বিপুল পরিমাণ চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যায়। এসব পয়েন্টে প্রায় অর্ধশতাধিক চোরাকারবারি সক্রিয় রয়েছে চামড়া পাচারের কাজে। চামড়া পাচারের সঙ্গে যশোরে ১৫ জন, সাতক্ষীরার ১৮, কুষ্টিয়ার ছয়জন, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার আটজন এবং ঝিনাইদহ জেলার সাতজন রয়েছে । ভারতে চামড়ার দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় ও বাংলাদেশের পশুর চামড়ার সেখানে ভাল চাহিদা থাকার কারণে সাধারণভাবে বছরজুড়েই এ পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে। অন্যদিকে কোরবানির এ সময়টিতে পাওয়া বিপুল পরিমাণ চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থাও দেশের সব স্থানে নেই।
ঈদ-উল-আজহায় কোরবানির পশুর চাহিদা, উৎপাদন, সরবরাহ ও চামড়া শিল্পের ক্রমাবনতির ওপর সরকারী একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের রফতানিমুখী খাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম হলো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। চামড়া শিল্পের প্রধান উপকরণ কাঁচা চামড়ার বার্ষিক জোগানের প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি আসে পবিত্র ঈদ-উল-আজহার কোরবানির পশু থেকে। গত বছরের কোরবানির সময় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পশুর চামড়ার জোগান ছিল। এবারের কোরবানির ঈদে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জড়িত রয়েছে। কিন্তু দেশের এ সম্ভাবনাময় খাতটি গত তিন বছর ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাতেই রয়েছে চামড়ার হাট। তবে সব থেকে বেশি ট্যানারি রয়েছে যশোর জেলায়। যশোরের রামনগর, রাজারহাটের চামড়া হাটে যশোরসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা চামড়ার বিপণন হয়ে থাকে। এ হাট দুটিতে কোরবানির সময়ে প্রায় ৬০-৭০ হাজার পিস চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে। এ চামড়ার প্রায় ৮০ শতাংশই ঈদ পরবর্তী কয়েক মাস ধরে ভারতে পাচার হয়ে চলে যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় চামড়ার পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর প্রশাসন। চামড়া পাচার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা জানিয়ে দেয়া হয়েছে বিজিবি-পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। চামড়া পাচারের বিষয়টি সব সীমান্ত দিয়েই ঘটা একটি সামাজিক প্রপঞ্চের মতো হয়ে গেছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশের বাজারে বিপুল চামড়ার সরবরাহ হওয়ায় তা চামড়ার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। দেশে চামড়ার ব্যবসায়ীরা বেশি নজর দিয়ে থাকেন তাদের বিনিয়োগের ওপর। যার কারণে যে কোন উপায়ে তারা বিনিয়োগ তুলে আনতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রয়োজনে সেটি অবৈধ উপায় হলেও তারা সে উপায় বেছে নেন। চামড়া ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে দেশে চামড়ার দাম নির্ধারণ করার। কিন্তু সেটা হয়না। এ বছরও চামড়ার দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চামড়া পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভরতের পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী একটি চক্র জড়িত রয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে পুঁজির স্বল্পতা, নিয়ে তারা দুরবস্থায় আছেন। এবার লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ঢাকার বাইরের নির্ধারণ, প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া নির্ধারণ যা করা হয়েছে তা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চামড়া কিনলে লাভ হচ্ছে না। আর সে কারণেই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ভারতে ব্যবসা খুঁজে নেন। ঈদ মৌসুমে নগদ টাকায় চামড়া কিনতে হয়। সেগুলো বড় ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে মাসের পর মাসও টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করলে বেশি লাভ হয় ও নগদে টাকা পাওয়া যায়। ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য গরুর চামড়া জোগাড় করা কঠিন। তাই তারা প্রতিবছরই বাংলাদেশের এ সময়টির অপেক্ষায় থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা এদেশের অনেক ব্যবসায়ীকে অগ্রিম টাকাও দিয়ে রাখেন। যাদের মধ্যে কেবল সীমান্ত এলাকার নয়, ঢাকার কিছু ব্যবসায়ীও রয়েছেন।
এ বছর পবিত্র ঈদুল আয২হায় সারাদেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। যার মধ্যে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ, ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া ও অন্য ৭১৫টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সরকার এ বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গবাদিপশু ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম গ্রহণ করে। সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও আইসিটি বিভাগসহ অন্য দফতর-সংস্থা, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ অন্য বেসরকারী সংগঠন ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে গবাদিপশুর ডিজিটাল হাট পরিচালনা করে। করোনা পরিস্থিতির কারণে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ কমে গেলে এ শিল্প খাত কাঁচামাল সঙ্কটে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ সারা বছরের অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ করা হয় কোরবানির সময়।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ব্যাটালিয়নের একজন কমান্ডিং অফিসার বলেছেন, এ সময়ে চামড়া পাচার রোধ করতে তারা সব রকমের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা একটি শক্ত চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কঠিন। প্রতিবছরই বিজিবি প্রচুর চামড়া পাচারের সময় জব্দ করে। তারপরও পরের বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। বিজিবিকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে বিজিবি পোস্টে কড়া নজরদারি রাখা হবে।
সীমান্ত এলাকার একজন পুলিশ সুপার বলেন, চামড়া পাচার রোধে বিজিবির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ চেকপোস্ট বসানোসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সরকার চামড়ার দাম নির্ধারিত করে দিলেও ট্যানারি মালিকরা সেই দামে কিনছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারের নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কিনে তার থেকে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। চামড়া ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন, গ্রাম ও পাড়া মহল্লায় ঘুরে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা সরকারের নির্ধারিত দাম দিচ্ছেনা বলে অভিযোগ তাদের। চামড়ার দাম কম। তা ছাড়া ঢাকার মালিকরা বছরের পর বছর পাওনা টাকা শোধ না করায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করছেনা। ফলে চামড়ার আড়তে খেটে খাওয়া মানুষগুলো আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে। চামড়ার পাচার রোধকল্পে প্রকৃত মূল্য প্রাপ্তির পাশাপাশি চামড়া শিল্পকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে, কাঁচা চামড়া বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে বলে চামড়া ব্যবসায়ীরা মনে করেন বলে সীমান্ত এলাকার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে সীমান্ত এলাকার প্রশাসন চামড়া পাচার রোধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে পুলিশ প্রশাসনের দাবি।