আধ্যাত্মিক সম্রাট হযরত শাহজালাল (রহ:)

29

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক :

আধ্যাত্মিক রাজধানী নামে খ্যাত সিলেট অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন মুকুটহীন সম্রাট হযরত শাহজালাল (রহ.)। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাহাবী, তাবেঈন, তবে তাবেঈন, সলফে সালেহীন, গাউস, কুতুব, পীর ও ওলীদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসারতার মাধ্যমে আমাদের মাঝে ইসলাম এসে পৌঁছায়। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। ১৪ শতাব্দীতে যে সকল ওলী-আউলিয়ারা বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামের আলোয় আলোকিত করার ক্ষেত্রে যার নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং ভারতীয় উপমহাদেশে সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয় তাঁদের মধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) অন্যতম। উপমহাদেশে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও নামের মাহাত্ম্য অতুলনীয়। খাজা মইনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর পরে এই ভূখন্ডে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন হযরত শাহজালাল (রহ.)। সিলেট বিজয়ের পরে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গী-অনুসারীদের মধ্য থেকে অনেক পীর-দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
জনসাধারণের মাঝে হযরত শাহজালাল মুজাররদ ইয়ামনী (রহ.) হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর পূর্ণ নাম শেখ জালালুদ্দীন জালালুল্লাহ্। কুনিয়াত মুজাররদ। ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ সালে ৩২ বছর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের আধ্যাতিœক রাজধানী সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে জানা যায হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন ঐতিহাসিক অভিমত রয়েছে, তবুও হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত ফার্সি ভাষার একটি ফলক-লিপি থেকে উল্লিখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। জন্ম ও বংশ পরিচিতি ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুসারে ও গবেষকগণের মতে, হযরত শাহজালাল (রহ.) ৭৪৬ হিজরি সনের ১৯ জিলকদ ইন্তেকাল করেন। সে মতে তাঁর ১৫০ বছর জীবনকাল ধরে জন্ম সাল হয় (৭৪৬-১৫০)= ৫৯৬ হিজরি। হিজরি ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরাইশ বংশের একটি শাখা মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ইয়ামেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। এই শাখার হযরত শেখ মুহাম্মদ তাবরিজি (রহ.) ছিলেন হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর বাবা। তিনি কোরাইশ বংশীয় স্বনামধন্য খ্যাতিমান দরবেশ ছিলেন। সুহেলি ইয়ামনিতে উল্লিখিত তথ্য মতে, হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়ামেনের কুনিয়া নামক শহর। হযরত শাহজালাল (রহ.) যখন তিন মাসের শিশুসন্তান, তখনই তাঁর মা ইন্তেকাল করেন এবং পাঁচ বছর বয়সে বাবাও ইন্তেকাল করেন। অসহায় এতিম শিশুসন্তান হযরত শাহজালাল (রহ.)-কে মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী (রহ.) দত্তক নেন। আহমদ কবির তাকে আরবি ভাষায় কোরআন হাদিস শিক্ষা দেওয়াসহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজা) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন। হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি, তবে পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় হযরত শাহজালাল (রহ.)-কে তাঁর মুরীদ কর্তৃক মাওলানা সম্বোধন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন আলেম, এ ছাড়াও শায়খ আবু সাঈদ তাবরিজি (রহ.), বাহাউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রহ.) ও খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) তাদের মতো জগৎ খ্যাত তরিকতের ইমাম ও বুজুর্গ দরবেশ সাধকগণের শিষ্যত্ব ও সান্নিধ্য এবং যুগের দিকপাল মহান মনীষীগণের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব থাকাটাও প্রমাণ করে যে, হযরত শাহজালাল (রহ.) আধ্যাত্মিক অতিন্দ্রীয় জ্ঞান তো বটেই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জ্ঞানরাজ্যের বিভিন্ন শাখায়ও বুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
পুণ্যভূমি খ্যাত সিলেট আগমন বিভিন্ন জীবনীকারগণের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, হযরত শাহজালাল (রহ.) বাংলাদেশের সিলেটে আগমনের আগে, রাতে একটি স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত পীর মুর্শীদ ও মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী (রহ.) এবং সঙ্গীয় পীর বাহাউদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর (রহ.) কাছে বর্ণনা করেন। স্বপ্নের বিস্তারিত ঘটনা শুনে তারা অবিলম্বে হিন্দুস্তান যাত্রার আদেশ দেন। স্বপ্নের ইঙ্গিত মতে, মুর্শীদ একমুষ্ঠি মাটি তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, এই মাটির বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ যেখানে পাবে সেখানেই তুমি অবস্থান নিবে। তিনি আরও বললেন, এই মাটির মুষ্ঠি যে স্থানে খুলবে সে স্থানের মহত্ত্বের আর তুলনা থাকবে না। নির্দেশনা পেয়ে হযরত শাহজালাল (রহ.) দেরি করলেন না। বহুসংখ্যক ভক্ত-আশেকান নিয়ে সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন। হযরত শাহজালাল (রহ.) বাংলাদেশে আসার আগে তাঁর জন্মভূমি ইয়ামেন গমন করেন। সেখানে পূর্বপুরুষ ও মাতা-পিতার কবর যিয়ারত করেন। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, ইয়ামেনের বাদশাহও তার ব্যাপারে জানতেন। একবার শুনলেন হযরত শাহজালাল (রহ.) ইয়ামেনে আসছেন। বাদশাহর ইচ্ছা হলো- তাঁর আধ্যাত্মিকতা পরীক্ষা করার। যথারীতি হযরত শাহজালাল (রহ.) সহ সঙ্গীদের আপ্যায়ন করা হলো বিষ মেশানো শরবত দিয়ে। কিন্তু দেখা গেলো, ‘বিসিমল্লাহ’ বলে সে শরবত পান করে সবাই সুস্থ। কিন্তু স্বয়ং বাদশাহ সাধারণ শরবত খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন! প্রচলিত তথ্য অনুসারে, হযরত শাহজালাল (রহ.) তাঁর আধ্যাত্মিকতার বলে শরবতের বিষের ব্যাপারে জানতে পেরেছিলেন। এছাড়াও আধ্যাত্মিকতার বর্ণনা পাওয়া যায় যে, সিলেট নগরীর প্রধান নদী সুরমার পানি বেশিরভাগ সময়ই ঘোলা থাকে। এতে মানুষের খাবার পানির সংকট নিরসন করা যাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে এলাকাবাসী হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর কাছে গেলেন। তিনি সব শুনে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলেন। যখন মোনাজাত শেষ হলো তখন একটি গায়েবি আওয়াজে একটি কূপ খননের নির্দেশ পেলেন। সবাই মিলে তার দরবারের পাশে একটি কূপ খনন করলেন। এরপর এক শুক্রবার কূপের কাছে গিয়ে হাতে থাকা লাঠি উঁচিয়ে ধরলেন। আঘাত করা মাত্র গায়েবিভাবে নিচ থেকে পানি আসতে শুরু করল। শুধু পানিই নয়, পানির সঙ্গে করে রং-বেরঙের মাগুর, কৈ প্রভৃতি মাছও আসতে শুরু করল। সে মাছের বংশধরদের এখনো দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর আধ্যাত্মিকতার আরও উদাহরণ হল তাঁর উদ্দেশে পাঠানো নিজামুদ্দীন (রহ.)-এর আগুনে মোড়ানো রুটি পাঠানোর গল্পে। কিন্তু হযরত শাহজালাল (রহ.) না দেখেই জেনে গিয়েছিলেন এর ভিতরে কী আছে। কিন্তু রুটির কৌটাটি খুলে খেতে শুরু করলেন আগুনের টুকরোগুলোকে। অলৌকিকভাবে এ আগুন সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত হয়ে গেল। হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে নিজামুদ্দিন (রহ.) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ তাঁকে একজোড়া সুরমা রঙের কবুতর বা জালালি কবুতর উপহার দেন। সিলেটের আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দৃশ্যমান ওই কপোত যুগলের বংশধর। এগুলো জালালি কবুতর নামে খ্যাত। হযরত শাহজালাল (রহ.) যখন সিলেট পৌঁছেন তখন বাংলার শাসক সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ। তাঁর আমলে ৭০৩ হিজরিতে হযরত শাহজালাল (রহ.) আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে সিলেট বিজয় করেন। বর্ণিত আছে যে, গৌর গোবিন্দ কর্তৃক শেখ বুরহানুদ্দীন (রহ.)-এর শিশুপুত্র হত্যার প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে পাঠানো সিকান্দার গাজীর বাহিনী গৌর গোবিন্দের ক্ষমতার কাছে বার বার পরাজিত হয়। হযরত শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর অনুসারী ৩৬০ আউলিয়াসহ গৌর গোবিন্দের ক্ষমতাকে পরাজিত করে সিলেট বিজয় করেন। হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর প্রেমময় দ্বীনের আলো ছড়ালেন পুরো বাংলাদেশ। দেশের জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে, লোক সাহিত্যে, ধ্রুপদী সাহিত্যে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সর্ব ক্ষেত্রে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর প্রভাব পাওয়া যায়। চিশতিয়া তরিকার বুজর্গগণের মালফুয়াত, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উক্তি বাংলার শাসকদের বিভিন্ন স্থাপনা ও শিলালিপি, তাঁর নামে স্থানের নামকরণ ও মুদ্রার প্রচলন তা প্রমাণ করে। বাংলার ইতিহাসে এমন কোনো শাসকের দরবার নেই যা হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরবারের অনুগ্রহে অনুগৃহীত হতে চায়নি। দেশের রাজনৈতিক শাসক যারাই হোন না কেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে সমাসীন। তিনি সিলেট অঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট। সিলেট বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও পুণ্যভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সিলেট নগরীর মধ্যখানে সবুজ টিলার ওপর চিরনিদ্রায় শায়িত হযরত শাহজালাল (রহ.)। তাঁর ইন্তেকালের সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে, তবে ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ১৫০ বছর বয়সে ৭৪৭ হিজরি ১৩৪৭ সালে ইন্তেকাল করেন। ওফাতের আগের দিন তাঁর মুরিদগণকে ডেকে বললেন, তোমরা আল্লাহর প্রতি ইমান রাখবে, আল্লাহকে ভয় করবে। রাসূল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করবে। আল্লাহর হুকুমে আমি কাল তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব। পরের দিন জোহরের নামাজের শেষ সিজদারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। পাশেই অলৌকিকভাবে একটি কবর খোদিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেই কবরে কাফন ও খুশবু-আতর মজুদ ছিল। মুরিদগণ তাঁকে সে কাফন পরিয়ে জানাজা সম্পন্ন করে দাফন করলেন।