করোনায় থমকে আছে এস কে সিনহা-মিজান-বাছিরের মামলার বিচার

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল দেশব্যাপী বিধিনিষেধ (লকডাউন) জারি করে সরকার। এ বিধিনিষেধে নিম্ন আদালতের বিচারিক কার্যক্রম চলছে সীমিত পরিসরে। এ সময় শুধু সদ্য গ্রেফতার (প্রোডাকশন) আসামিদের রিমান্ড, জামিন ও নতুন মামলার ফাইলিং (নিবন্ধন) শুনানি চলছে সশীরে। এছাড়া ভার্চুয়ালি চলছে রিমান্ড ও জামিন শুনানি।
নেয়া হচ্ছে না কোনো মামলার সাক্ষ্য। হচ্ছে না জেরাও। ফলে অনেক মামলার বিচারিক কার্যক্রমও থেমে আছে। করোনার কারণেই থেমে রয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা, পুলিশের সাময়িক বরখাস্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানসহ চারজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা এবং ডিআইজি মিজান ও দুদকের বরখাস্ত হওয়া পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণও। ফলে এগোচ্ছে না বিচার কার্যক্রমও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অনেক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও কার্যক্রম বন্ধ। আদালতের বিচারিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে থমকে থাকা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।
এস কে সিনহার দুর্নীতির মামলা :
ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলা এখন আটকে আছে তদন্তকারী কর্মকর্তা কমিশনের পরিচালক বেনজীর আহমেদের জেরার পর্যায়ে।
গত ১ এপ্রিল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে সাক্ষ্য দেন বেনজীর আহমেদ। এরপর আদালত তার জেরার জন্য ২০ এপ্রিল পরবর্তী দিন ধার্য করেন। কিন্তু এর মধ্যে ৫ এপ্রিল বিধিনিষেধ ঘোষণা হলে আদালতের সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর জেরার নতুন কোনো তারিখ ধার্য হয়নি।
২০১৯ সালের ১০ জুলাই দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা) মামলাটি করা হয়। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এ মামলার বাদী।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে চার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিলেন কথিত ব্যবসায়ী শাহজাহান ও নিরঞ্জন। সেই টাকা রনজিৎ চন্দ্র সাহার হাত ঘুরে বিচারপতি এস কে সিনহার বাড়ি বিক্রির টাকা হিসেবে দেখিয়ে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে।
এ মামলায় ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ। পরের বছরের ১৩ আগস্ট সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম।
পরে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ২১ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
মামলার আসামিদের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) কারাগারে। ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান ও একই এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা জামিনে আছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় পলাতক। মামলার এক আসামি মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহম্মেদ সালাম বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সাবেক প্রধান বিচারপ্রতি এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ রয়েছে। আদালতের বিচারিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।
২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
বন্ধ ডিআইজি মিজানসহ চারজনের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ :
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বন্ধ রয়েছে সাময়িক বরখাস্ত পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানসহ চারজনের দুর্নীতির মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক আসাদ মো. আসিফুজ্জামানের আদালতে দুই সাক্ষী বেসিক ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মমিনুল হক ও ডিজিএম সারোয়ার হোসেন সাক্ষ্য দেন মিজানের বিরুদ্ধে। সাক্ষ্য শেষে তাদের জেরাও করা হয়।
আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১২ এপ্রিল দিন ধার্য করেন। ৫ এপ্রিল বিধিনিষেধ জারি হলে আর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এখন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণের নতুন কোনো তারিখও ধার্য হয়নি।
২০১৯ সালের ২৪ জুন তিন কোটি সাত লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং তিন কোটি ২৮ লাখ টাকা অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগে মিজানসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে দুদক। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি দুদক পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০২০ সালের ১ জুলাই শাহবাগ থানা পুলিশ মিজানকে গ্রেফতার করে। পরদিন ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েসের আদালতে তাকে হাজির করা হয়। এরপর তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান বিচারক। ওই বছরের ২০ অক্টোবর ঢাকার ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আসিফুজ্জামান অভিযোগ গঠন করেন মিজানসহ চারজনের বিরুদ্ধে।
মিজান ছাড়া চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন তার স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্না ওরফে রত্না রহমান, ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান এবং ভাগনে মাহমুদুল হাসান। মাহমুদুল হাসান রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মিজানুর রহমান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রীকে গ্রেফতার করানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া এক সংবাদ পাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়। নারী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর তাকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদরদফতরে সংযুক্ত করা হয়।
প্রথম মামলাটির তদন্তকালে দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়ার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন ডিআইজি মিজান। পরে ঘুষ লেনদেনের বিষয়েও মামলা হয়।
এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ডিআইজি মিজানকে সাময়িক বরখাস্তের একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। সেই প্রস্তাবে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
বন্ধ রয়েছে মিজান-বাছিরের মামলার সাক্ষ্য :
অবৈধভাবে তথ্যপাচার ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত ডিআইজি মিজানুর রহমান ও দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণও বন্ধ রয়েছে বিধিনিষেধের কারণে।
সর্বশেষ গত ৩ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। এদিন আদালতে কোনো সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় দুদক সময়ের আবেদন করে। আদালত সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৫ এপ্রিল দিন ধার্য করেন। সেদিন থেকে বিধিনিষেধ জারি হলে আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এ কার্যক্রমের জন্য নতুন কোনো তারিখ ধার্য হয়নি। মামলায় মোট ১৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে দুদকের প্রথম মামলার তদন্ত চলাকালে তিনি গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে প্রথম মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক এনামুল বাছির তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
এ অভিযোগ ওঠার পর বাছিরকে সরিয়ে দুদকের আরেক পরিচালক মো. মঞ্জুর মোরশেদকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদকের আরেক পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যাকে প্রধান করে তিন সদস্যের দলকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়।
অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই মিজান ও বাছিরের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলাটি করেন শেখ মো. ফানাফিল্যা। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও তিনি।
২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েসের আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা। ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস আসামিদের উপস্থিতিতে এ চার্জশিট গ্রহণ করেন। ১৮ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোশাররফ হোসেন কাজল ণ্ডবলেন, ‘মহামারি পরিস্থিতিতে ডিআইজি মিজান ও দুদকের পরিচালক বাছিরের দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ রয়েছে। আদালতের বিচারিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।’