সিলেটের সাংবাদিকতায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ফররুখ আহমদ চৌধুরী

49

নাছির আহমদ খান :

সিলেটে ইদানীং অনেক জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক রয়েছেন তবে কালের আবর্তন খোদা প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিয়মে আবার হারিয়ে গেছেন সিলেটের বহু যুগশ্রেষ্ঠ লেখক বুদ্ধিজীবি ও কালজয়ী সাংবাদিক। অনেকে বার্ধক্যজনিত বা নানা কারণে হয়তো সাংবাদিকতা পেশা থেকে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।
যাদের কথা, যাদের ক্ষুরধার লেখনী, সাংবাদিক অঙ্গণে অবদান ও ভৃমিকা নতুন প্রজন্মের অনেক সাংবাদিকদের জানা নেই। আবার অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ভুলেও গেছেন। লেখক ও সাংবাদিকদের এ নিদানকালে মনে পড়ে সিলেটের প্রচারবিমুখ একজন জৈষ্ঠ্য, সৎ সাহসী ও চরম বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিককের কথা। তিনি জীবিত থাকলেও বর্তমানে সাত সমুদ্দুরের ওপারে রয়েছেন। তিনি হচ্ছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় বড়ভাই সিলেটের প্রথিতযশা জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক ফররুখ আহমদ চৌধুরী । সর্বমহলে যিনি ফখরুভাই নামে বহুল পরিচিত। সুখে-দুঃখে সবসময় তিনি সাংবাদিকদের পাশে থাকতেন এবং সুদূর প্রবাসে থেকে এখনো পাশে আছেন।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ফখরু ভাই অত্যন্ত অমায়িক, মানবিক ও মার্জিত স্বভাব চরিত্রের এক সাদা মনের মানুষ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক,লেখক ও সাংবাদিক অঙ্গণের সদা হাস্যোজ্বল এবং প্রচারবিমুখ মানুষটি এখনও সুদূর প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সরাসরি জড়িত । লেখালেখি ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে বাংলাদেশী সংস্কৃতিকে বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক ফররুখ আহমদ চৌধুরী ফখরু ভাইয়ের জন্ম ১৯৬৩ সালে সিলেট নগরীর খুলিয়াপাড়ার বশির মঞ্জিলে। পিতা মরহুম আলহাজ্ব বশির আহমদ চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন সিলেট মহকুমা (বর্তমান জেলা) নাজির। তিনি ২০০৩ সালে ইন্তেকাল করেন । ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ও তার ভাই শিল্পপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী এবং ২ বোন আমেরিকা প্রবাসী ও ১ বোন ইংল্যান্ডে থাকেন। বড়ভাই বদরুল আহমদ চৌধুরী পরলোকগত। ফখরুভাই ছোটবেলা থেকেই পত্রপত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা অসংখ্য কবিতা ও ছড়া সিলেটের প্রায় সকল স্থানীয় পত্রিকাসহ জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য পাতায় স্থান করে নিতো। সিলেটের সাহিত্যানুরাগীদের মাঝে তিনি ছড়াকার ফখরু ভাই বলে ছিলেন সর্বাধিক সমাদৃত। সিলেটে সাংবাদিকতা (জার্নালিজম) বিষয়ে একাডেমিক ভাবে শিক্ষিত ও দীক্ষিত হাতেগুনা দুই-তিনজন সাংবাদিকের মধ্যে ফররুখ আহমদ ফখরু ভাই অন্যতম। ইন্সটিটিউট অব জার্নালিজম বিয়য়ে তিনি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭৯ সালে সাপ্তাহিক “দেশবার্তা” পএিকার মধ্যে দিয়ে সাংবাদিকতার জগতে পা রাখেন সিলেটের এ গুণী সাংবাদিক ফররুখ আহমদ চৌধুরী।
ফখরু ভাই কখনো নিজেকে বড় সাংবাদিক বলে আত্মপ্রচার করতেন না। অত্যন্ত সাদাসিদে পোশাকে চলাফেরা করতেন। সাংবাদিকতার পেশাকে অর্থবিত্ত, বৈভব ও অসৎ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার কাজে লাগাননি তিনি, যা বর্তমান সময়ের কিছু সাংবাদিকের মোহ হয়ে ওঠেছেন।
নিজেকে সৎ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সারা জীবন নিরলস কাজ করে চলেছেন সময়ের এ সাহসী সাংবাদিক।
দেশে থাকাবস্থায় তিনি দৈনিক সিলেটের ডাক-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সিলেট শহর প্রতিনিধি। পরে ১৯৮১ সালে দৈনিক দিনকাল-এর সিলেট জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে ‘সাপ্তাহিক সিলেট” নামে নিজ সম্পাদনায় একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি ‘দৈনিক কাজিরবাজার’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দীর্ঘদিন নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং কাজিরবাজার পত্রিকায় তার অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া দেশের বাইরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সেমিনারেও যোগদান করেছেন তিনি। সাংবাদিকতাকে পরিপূর্ণ ভাবে মেলে ধরতে ও নিজ জীবনকে বৈচিত্রময় করে তুলতে ভারত নেপাল ও ভুটানসহ সার্কভুক্ত কয়েকটি দেশও ভ্রমণ করেন তিনি। প্রচলিত নিয়মের সাংবাদিকতা ছাড়াও ছড়া কবিতা প্রবন্ধ ও বই লেখালেখিতেও নিমগ্ন থাকতেন।
তাঁর প্রকাশিত প্রথম ছড়ার বই “২১শে ছড়া” প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর আরও কিছু বই বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখ্যযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- সিলেট গাইড(১৯৯০), সুগন্ধা রিপোর্টিং, সাহিত্য সাময়িকী বিনিময়(১৯৮৭), আজকের সূর্যোদয় রিপোর্টিং।
এছাড়াও তিনি সিলেটের ইতিহাস নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী দীর্ঘ রচনা লিখেন, যা ন্যাশনাল সাইকোপিডিয়া (বাংলা বিশ্বকোষ)-এ অন্তর্ভুক্ত আছে। গুগলে সার্চ দিলেই আমরা এই লেখাটি দেখতে পারি।
“সাপ্তাহিক সিলেট” পত্রিকা বের করার পর তিনি অতি সাহসিকতার সাথে সমাজের অন্যায় অনাচার ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। ঐ সময়ে সাপ্তাহিক সিলেট “নগরে হর হরদম সরকারি গাড়ির পাইকারী ব্যবহার”, ও “ম্যাজিষ্ট্রেট কায়কোবাদ সিলেটে বেশ জনপ্রিয়”! শিরোনামে বেশকিছু সংবাদ ছাপা হয়।এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৯৪ সালে সাবেক জেলা প্রশাসক পত্রিকা ও নিউজ সংক্রান্ত বিষয়ে অহেতুক হয়রানী করতে একটি ষড়যন্ত্র মূলক মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ফখরু ভাইকে গ্রেফতার এবং পএিকার প্রকাশনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গ্রেফতারের খবর পেয়ে ঐ সময়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক আবদুল লতিফ এর সাথে সাক্ষাত করেন. অসুকা ফেলোপ্রাপ্ত সাংবাদিক সাপ্তাহিক সিলেটের নির্বাহী সম্পাদক ফতেহ ওসমানী, গবেষক সিলেটের বিশিষ্ট সাংবাদিক আ.ফ.ম সাঈদ, দৈনিক সিলেটের ডাক’র নির্বাহী সম্পাদক মোঃ আব্দুস ছাওার, দৈনিক উত্তর পূর্ব’র সম্পাদক আজিজ আহমদ সেলিম. গ্রাম সুরমার সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক মহিউদ্দিন শিরু, বিশিষ্ট সাংবাদিক হারিস মোহাম্মদ, দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকার সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক মুকতাবিস উন নূর ও দৈনিক ইনডিপেনডেট’র সিলেট প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তারা ফখরু ভাইকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তাকে অবিলম্বে মুক্তির দাবী জানান। একই দিকে ফখরু ভাইকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে আজকের সূর্যোদয় পএিকায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়।এছাড়া সাংবাদিক আ.ফ.ম সাইদ, ফখরু ভাইকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আজকের সূর্যোদয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করেন। এদিকে সাংবাদিক ফখরু ভাইকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সিলেটের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন তার মুক্তির দাবী জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। খবর পেয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস ছামাদ আজাদ ২৪ ঘন্টার ভেতরে সাংবাদিক ফখরু ভাইকে মুক্তি দিতে তৎকালীন জেলাপ্রশাসককে নির্দেশ দেন।পরবর্তীতে ফখরু ভাই মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পর সিলেটের বিশিষ্ট সাংবাদিক ঐ সময়ে দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধি চৌধুরী মুমতাজ আহমদ সহ অনেকে টেলিফোন ও তার বাসায় গিয়ে খোজ খবর নেন। পরবর্তীতে সাংবাদিক ফখরুভাই তার পএিকার রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা বাতিল করতে নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পযর্ন্ত দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ে জয়ী হয়ে সাপ্তাহিক সিলেটের প্রকাশনা পুনরায় ফিরিয়ে আনেন। ২০০৫ সাল থেকে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সিলেট নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। তবে একটি প্রভাবশালী মহলের প্ররোচনায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। সিলেটে একমাত্র তিনিই সরকারের সাথে আইনি লড়াই করে পত্রিকার মামলায় জয়লাভ করে সাংবাদিকতা ও পত্রিকার প্রকাশনা জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ফখরু ভাইয়ের খুরদার লেখনি ও সৎ সাংবাদিকতার সামনে কুচক্রী মহল মাথা নতো করতে বাধ্য হয়। অনেক বাধা বিপত্তি ও হয়রানীর রুদ্ধশ্বাস বেড়াজাল চ্ছিন্ন করে তিনি সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০১৪ সালে স্বপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমান তিনি।
দেশে থাকাকালীন ফররুখ আহমদ চৌধুরী ফখরু সম্পাদিত সাপ্তাহিক সিলেট ও দৈনিক কাজিরবাজার পত্রিকার মধ্য দিয়ে আজকালের অনেক নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকের হাতে খড়ি হয়েছে। তারা অনেকে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই অনেকেই তাকে সৎ -সাহসী সাংবাদিক গড়ার কারিগর হিসেবে ডাকেন। সুদুর প্রবাসে গিয়েও সাংবাদিকতা বিমূখ হননি ষাটোর্ধ ফররুখ আহমদ চৌধুরী ফখরু ভাই। এখনো তিনি আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ” বাফেলো বাংলা” পত্রিকার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ” জনতার কন্ঠ” এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ” সিলেট থ্রো দ্যা লেনস” এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সাংবাদিকতা আর লেখালেখি যেন তাঁর জীবন সুতোয় গাঁথা। সময় সুযোগ পেলেই খাতা কলম নিয়ে বসে পড়েন। শব্দের গাঁথুনিতে নতুন কিছু সৃষ্টির নেশায় থাকেন। বর্তমানে তাঁর বেশ কিছু পান্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। যেমন- ‘প্রতিদিনের প্রতিচ্ছবি, যখন রিপোর্টার ছিলাম, কিভাবে সাংবাদিক হলাম, ব্যক্তিগত ফটো এ্যালবাম, রিপোর্টারের ডাইরী, নিউইর্য়কের চিঠি, অনুসন্ধানী রিপোর্টিং নিয়ে কিছু কথা’ প্রভৃতি।
সিলেটের প্রথিতযশা জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক ফররুখ আহমদ চৌধুরী ফখরু ভাই বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো শহরে স্বপরিবারে বসবাস করছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ২ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর বড় ছেলে শাহী ফররুখ মাহমুদ চৌধুরী (মাহি) বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন। পাশাপাশি মাহি বাফেলো সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন এবং বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক – সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তাঁর ছোট ছেলে শাফী ফররুখ মাহমুদ চৌধুরী (আদনান)এ লেভেলে অধ্যয়নরত আছে। সে তার বিগত ও-লেভেল পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল অর্জন করে বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করেছে।
ফখরু ভাই সাংবাদিকতা পেশাকে কখনো কলুষিত কিংবা অসৎ কাজে ব্যবহার করেননি। অত্যন্ত দিলখোলা ও বন্ধুবৎসল তিনি। সুদূর প্রবাস থেকেও তার সহকর্মী সিলেটের সাংবাদিকদের তিনি খোঁজ খবর নেন। প্রবাসে থেকেও তাদের ভুলে যাননি। তাদের আপদে বিপদে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে থাকেন। (তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি)।
আল্লাহ মেহেরবান তিনি দয়ালু তিনি ফখরু ভাইকে হেফাজত করবেন ইনশাআল্লাহ। আমিন।