মানব জীবনে কুরআন হাদীস

28

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
পানাহার : পর্ক বা শুকুরের মাংস বা চর্বি কোনভাবেই গ্রহণ করা যাবে না। মদের ব্যাপারেও এই একই কথা। ইসলাম উভয়টাকেই হারাম করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি ভ্রান্তির অপনোদন হওয়া আবশ্যক। কুরআন মাজীদে ‘খামর” একটি শব্দ আছে। সাধারণত আঙ্গুর থেকে তৈরি মদকে খামর বলে। কিন্তু নবী করীম (সা.) এর যামানায় যে কোন প্রকার মদকেই ‘খামর’ বরে চিহ্নিত করা হত। সেখানে মদ কি দিয়ে তৈরি করা হত তা ছিল গৌণ। তাই দেখা যায় যে, ‘খামর’ সংক্রান্ত আয়াতটি যখন প্রথম নাযিল হয় তখন মদীনার মুসলমানগণ শুধু মদই ফেলে দেয়নি। বরং দেহের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এ জাতীয় সমস্ত পানীয়কে তারা নষ্ট করে ফেলে। সে আমলে মদীনায় খেজুর থেকেও এক ধরনের পানীয় তৈরি করা হত। কিন্তু এ পানীয়টি উত্তেজনা সৃষ্টি কারী ছিল বিধায় তাও ফেলে দেওয়া হয়।
যে পশু বা পাখি ইসলামী কায়দায় যবেহ করা হয়নি, মুসলমানরা তার গোশত আহার করতে পারে না। এমনকি কোন অমুসলিম যদি গরু বা ছাগল যবেহ করে, তাহলে সে গরু বা ছাগলের গোশত খাওয়া মুসলমানদের জন্য হারাম। আবার একজন মুসলিম যদি রীতিসিদ্ধ ভাবে যবেহ না করে একটি মুরগী ছানাকে গলাটিপে মেরে ফেরে, তাও হারাম হয়ে যায়।
পাখি বা পশু যবেহ করার ইসলামী কায়দা এই যে, বিসমিল্লাহ বরে যবেহ করতে হবে। যবেহ করার সময় শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও গলার দুটি রগ কেটে দিতে হবে। কিন্তু পশু-পাখির মেরুদন্ড বা গলার হাদ দ্বিখন্ডিত করা ঠিক নয়। তাছাড়া প্রানীটি মরে যাওয়ার পূর্বে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার বা চামড়া ছাড়া নিষেধ।
খাওয়া-দাওয়ার জন্য স্বর্ণ বা রৌপ্যের তৈরি থানা বা তৈজসপত্র ব্যবহার করা হারাম। নবী করীম (সা.) বলেছেন যে, পুরুসের জন্য স্বর্ণ বা সিল্কের ব্যবহার করা হারাম। নারীর জন্য এটা জায়েয।’ অবশ্য স্থান বিশেষে এর কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন-সামরিক পোশাক হিসাবে সিল্কের ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। দাত বাধানোর জন্য স্বর্ণেল ব্যবহার করা জায়েয। জানা যায়, খলীফা উসমান (রা.) এর দাত স্বর্ণ দ্বারা বাধান ছিল। আরফাজা ইবন আসাদ নামক জনৈক ব্যক্তি বর্ণিত এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, একবার এক যুদ্ধে তাঁর নাক কাটা যায়। এবঙ তিনি রূপোর তৈরি একটি নকল নাক ব্যবহার করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রিয়নবী (সা.) এর অনুমতিক্রমে তিনি রুপোর তৈরি নাকের পরিবর্তে স্বর্ণের তৈরি নাক ব্যবহার করতে শুরু করেন।
পোশাক ও কেশ বিন্যাস রীতি : মুসলমান পুরুষদের জন্য স্বাভাবিক রেশম (সিলক) দিয়ে তৈরি পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করা হারাম। অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে পোশাক লাল রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে। নবী করীম (সা.) দাড়ি রাখতেন। তিনি দাড়ি রাখার জন্য জোড় তাকিদ দিয়েছেন। মুসলমানদের পোশাক এমন হতে হবে যাতে সমস্ত শরীর ঢেকে থাকে। পোশাকটি হতে হবে শালীন ও রুচিসম্মত। তারা এমন পোশাক পরিধান করবে না যাতে গলা ও কাধ বেরিয়ে থাকে, আবার পোশাকটি এমন পাতলাও স্বচ্ছ হওয়া উচিত নয় যাতে শরীরের আব্রু থাকে না অথবা নগ্নতা প্রকাশ পায়। তাছাড়া যে সমস্ত পোশাকের কারণে অন্যরা মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তেমন পোশাককে সর্বোতভাবে পরিহার করতে হবে।
ওযু ও সালাত : নবী করীম (সা.) বলেছের যে, “পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।” সে কারণে সালাত আদায় করার শুরুতেই একজনকে দৈহিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। তবে সালাত আদায়ের পূর্বে সাধারণভাবে ওযু করতে হবে। ওযু করার আগে প্রয়োজনে গোসল করতে হবে। আর শুক্রবার জুম’আর সালাতের পূর্বে গোসল করার জন্য বিশেষ তাকিদ রয়েছে। ইসলামে গোসল করারও একটা নিয়ম আছে। প্রথমে তাকে ওযু করতে হবে। তারপর সারা শরীরে পানি দিয়ে ভালভাবে ধৌত করতে হবে। আর কুয়ো বা বালতির পানি দিয়ে গোসল করলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কমপক্ষে তিনবার পানি ঢালতে হবে।
ওযু করার নিয়মটা এ রকম : প্রথমে পবিত্রতা অর্জনের জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ নিয়ত করতে হবে ও বিসমিল্লাহ বলতে হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হবে ঃ দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত ধোয়া, পানি দিয়ে কুলি করা, নাক পরিস্কার করা, কপাল থেকে থুতনি এবং এক কান থেকে অপর কান পর্যন্ত সমস্ত মুখমন্ডল ধোয়া, প্রথমে ডান হাত এবং পরে বাম হাতের কনুই পর্যন্ত ধোয়া, মাথা মাসেহ করা, সর্বশেষ ডান বা বাম পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ধোয়া। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কাজ তিনবার করতে হবে। আর যদি এরকম হয় যে, কোথাও ওযু করার মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তাইয়াম্মুমের বিধান রয়েছে। তাছাড়া যে রুগ্ন, চিকিৎসাগত কারণে যে পানি ব্যবহার করতে পারে না, তার জন্যও তায়াম্মুমের অনুমোদন রয়েছে। তায়াম্মুমের বেলায়ও প্রথমে পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিয়ত করতে হবে, এবং বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হবে। তাপর সে পরিষ্কার মাটির উপর হাত রাখবে, এবং দু’হাতের তালু দিয়ে মুখমন্ডল মুছে ফেলবে। সে আবার মাটিতে হাত রাখবে অতঃপর বাম হাতের তালু দিয়ে ডান হাতের কনুই পর্যন্ত মুছে ফেলবে এবং ডান হাতের তালু দিয়ে বাম হাতের কনুই পর্যন্ত মুছে ফেলবে। বস্তুতপক্ষে এটা হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি মানুষের বিনয়-নম্রভাব প্রকাশের একটা নমুনামাত্র। বিভিন্ন কারণে ওযু নষ্ট হতে পারে। যেমন-মুখ ভর্তি বমি করা, ঘুম আসা, পায়খানা-প্রশ্রাব করা প্রভৃতি। তখন সালাত আদায় করতে হলে তাকে পুরনায় ওযু করতে হবে। ওযু ভঙ্গের আরো কারণ আছে।
সালাত আদায় করার শর্ত এই যে, তার কাপড় পাক হতে হবে, জায়গা পাক হতে হবে, তাকে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াতে হবে। আর কিবলা নির্বাচন করাটাও কঠিন কোন ব্যাপার নয়। বিশ্বের একটি সাধারণ মানচিত্র দেখেও এটা নির্ধারণ করা যায়। কম্পাসের সাহায্যে দিক নির্ণয় করা আরো সহজ। বলে রাখা আবশ্যক যে, পৃথিবী গোলাকার। ফলে যে দিকে মুখ করে দাড়ালে কা’বা সবচেয়ে কাছকাছি হয়। সালাতে সে দিকে মুখ করে দাড়াতে হবে। যেমন যারা নিউইয়ক শহরে আছে তারা পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ মুখ করে দাড়ালে কা’বা সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি হবে। কিন্তু ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা সরাসরি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মুখ করে দাড়াবে। (বাংলাদেশীদের ও দাড়াতে হবে পশ্চিম মুখী হয়ে)। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে হয়। তন্মধ্যে শুক্রবার যোহরের সালাতের পরিবর্তে বৃহত্তর জামাতে জুম’আর সালাত আদায় করা হয়। তাছাড়া আরো দুটি বাৎসরিক সালাতের ব্যবস্থা আছে। একটি রমযান মাসে সিয়াম পালনের পর ১ শওয়াল দিবসে, অপরটি মক্কা নগরীতে হজ্ব উদযাপনের সময়ে ১০ যিলহজ্বে। প্রথমটি ঈদুল ফিতরের সালাত দ্বিতীয়টি ঈদুল আযহার সালাম। এ দুটি ঈদে খাদ্য খাবারের আয়োজন করা হয়।
সব সালাতের নিয়ম-রীতি ও ভঙ্গিমা একই ধরনের। পার্থক্য শুধুমাত্র রাকআতের ক্ষেত্রে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মধ্যে প্রথমেই আসে ফজরের সালাত। ফজরের সালাতে দু’রাকআত ফরয আর মাগরিব ওয়াক্তে পড়েত হয় তিন রাকাত ফরয। আর যোহর, আছর ও ইশার সালাতে ৪ রাকআত করে ফরজ আদায় করতে হয়। শুক্রবার জুম্মার এবং বাৎসরিক সালাতের প্রতিটি দু’রাকআত ফরজ আদায় করতে হয়। কিন্তু বাৎসরিক সালাত দুটি ওয়াজিব আর জুম্মার সালাত ফরজ। নবী করীম (সা.) এর বাইরের ‘ইশার সালাতের পর আরো তিন রাকআত সালাত আদায় করার জন্য তাকীদ দিয়েছেন। এটাকে বলে বিতরের সালাত।
দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরজ। নবী করীম (সা.) প্রতি ওয়াক্তেই ফরযের অতিরিক্ত আরো কিছু সালাত নিয়মিতভাবে আদায় করতেন। ফরজের অতিরিক্ত এ সালাত সুন্নত হিসাবে পরিচিত। ফজরের ফরজ দু’রাকআতের পূর্বে ২ রাকআত সুন্নত, দুপুরে যোহরের ফরজ সালাতের পূর্বে ৪ রাক’আত, সুন্নত এবং পরে দু’রাকাত সুন্নত, সন্ধ্যায় মাগরিবের ফরজ সালাতের পর দু’রাকাত রাতে ইশার ফরজ সালাতের পর দু’রাকআত সুন্নত এবং তিন রাকআত বিতরের সালাত আদায় করা ছাড়াও একজনের ইচ্ছা করলে আরো অনেক সালাত আদায় করতে পারে। কিন্তু এর সবটাকেই বলা হয় নফল ইবাদত। সালাত ফরজ, সুন্নত বা নফল যাই হোক না কেন, যুত আদায় করা যাবে সওয়াবও হবে তত বেশি। তাছাড়া মসজিদে প্রবেশের পর দু’রাকআত সালাত আদায়ের জন্য মুসলমানগণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটাকে বলে তাহিয়্যাতুল মসজিদ।
সালাত আদায়ের নিয়মটা এ রকম : প্রথমে ওযু করবে, সালাতের জন্য উপযুক্ত স্থান বেছে নিয়ে কিবলামুখী হবে, কান পর্যন্ত দু’হাত উঠিয়ে সালাতের নিয়ত করবে। নিয়তের বাংলা তরজমা এ রকম, আমি অমুক ওয়াক্তের অত রাকআতের ফরজ বা সুন্নত সালাত কিবলামুখী হয়ে একাকী অথবা সম্মিলিতভাবে ইমাম হিসাবে অথবা ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে আদায় করছি। নিয়ত বলার পর আল্লাহু আকবার বলে দু’হাত বাঁধতে হবে। বাম হাতের উপর ডান হাত থাকবে। হানাফী, শাফী এবং হাম্বলী মাজহারের অনুসারীরা এ নিয়ম অনুসরণ করে থাকেন। কিন্তু মালিকী ও শিয়া মজহাব অনুসারে আল্লাহু আকবার বলার পর দু’হাত দু’পাশে লম্বালম্বি ঝুলিয়ে রাখতে হয়। এর পর শুরু হয় সালাতের মূল পর্ব। তখন আর কারো সঙ্গে কথা বলা যাবে না। কোন দিকে তাকান যাবে না। দৃষ্টি থাকবে সিজদায় গেলে কপাল যেখানে ঠেকবে ঠিক সে স্থানে। উঠা-বসা, সিজদা বা রুকুতে যাওয়ার সময় প্রতিবারেই তাকে আল্লাহু আকবার বলতে হবে। (অসমাপ্ত)