আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…..

18

জেড.এম. শামসুল  :
বাঙালি জাতি যখন মায়ের ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভোর তখন প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনতন্ত্র পরিকল্পিতভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পিছপা হয়নি। অব্যাহত ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে গিয়ে এবং ২১ ফেব্রুয়ারী সহ আন্দোলন সংগ্রামে হতাহতের সঠিক সংখ্যা পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত হতাহতের সংখ্যা কম নয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী পূর্বঘোষিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ হরতাল বিক্ষোভ কর্মসূচী ছাত্র জনতার মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগে। এদিন ভোরবেলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় জমায়েত হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সকাল ১১টায় আমতলায় ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে এক সভায় সকল নেতৃবৃন্দের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, ১০ জন করে গ্রুপ করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। ১০ জন করে গ্রুপ বের হয়ে রাজপথে বেরুলে পাকিস্তানী পেটুয়া বাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে। ছাত্র-জনতা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে পুলিশ বাহিনী বেলা ২টার দিকে ছাত্র জনতাকে বাধার সৃষ্টি করে। এ সময় মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন রাস্তায় ছাত্রদের সমাবেশ করে গণপরিষদের দিকে যাত্রা শুরু করলে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে অবশেষে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। তাদের বেপরোয়া গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ’র ছাত্র মোঃ সালাহউদ্দিন (২৬) ঘটনাস্থলে মারা যান। অপর গুলিবিদ্ধ আব্দুল জব্বার (৩০) আবুল বরকত (২৫) রফিকুদ্দীন আহমদ (২৭) মৃত্যু ঘটে। আহতদেরকে আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। পাকিস্তানী মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনীর গুলিবর্ষণ ও বরর্বোচিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৫ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৯৬ ঘন্টার ধর্মঘট হরতালের ডাক দেয়। এদিন পাকিস্তানী বরর্বোচিত হামলার ঘটনায় যদিও প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা পাওয়া যায়নি, তবুও বিভিন্ন সূত্র মতে বাংলা ভাষার জন্যে যেসব ছাত্র শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালাহ উদ্দিন, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আব্দুল জব্বার যারা আহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মোহাম্মদ মোতালেব, আবু চৌধুরী, মাসুদুর রহমান, এলাহি বক্স, আব্দুস সালাম, ২৩ ফেব্রুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। আনোয়ারুল ইসলাম, মনসুর আলী, তাজুল ইসলাম, রশিদ উদ্দিন আহমদ, এ সালাম, এম আখতারুজ্জামান, আব্দুর রাজ্জাক, মোজ্জামেল হক চৌধুরী, সুলতান আহমদ, এ রাসেল প্রমুখ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে পাকিস্তান সরকার রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত শহরে সন্ধ্যা আইন জারী করে। সেনাদল রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারী এদিন রাতেই পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন এক প্রস্তাবে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণের জন্যে পাকিস্তান গণপরিষদের নিকট সুপারিশ করা হয় এবং এ দিনের গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে প্রেসনোটে প্রচার করা হয়। এদিন কলকতা থেকে কোন পত্রিকা বিলি হয়নি। ফলে ছাত্র-জনতা ঢাকার একমাত্র ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা মনিং নিউজ ছাপাখানা পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিবর্ষণ, ছাত্রদেরকে হত্যার প্রতিবাদে সারা বাঙালায় হরতাল অব্যাহত থাকে। এদিন পাকিস্তানী বরর্বোচিত গুলিবর্ষণে আহত হয়ে প্রাণ হারান অজ্ঞাতনামা সাত বছরের বালক, আব্দুল আউয়াল, শফিউর রহমান, আহতাবস্থায় ৪০/৫০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে আহতাবস্থায় আব্দুস সালাম মারা যান। তবে পাকিস্তানী বরর্বোচিত গুলিবর্ষণে মোট হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। এদিন গায়বানা জানাযা, দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে। হত্যা, নির্যাতন, নির্বিচারে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আইন পরিষদ সদস্য আবুল কালাম শামছুদ্দিন আইন পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতন, জেল জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে সংগ্রাম পরিষদ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়।