চুনারুঘাটের বাল্লা সীমান্তে কলা চাষে কৃষকদের ভাগ্যবদল

3
smart

চুনারুঘাট থেকে সংবাদদাতা :
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা সীমান্তে পতিত জমিতে কলা চাষে স্বল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় চাষীদের ভাগ্যবদল সহ কলা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা গাজীপুর ইউনিয়নের বাল্লা ও টেকারঘাট গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রায় শত বিঘা জমিতে কলা চাষাবাদ হয়েছে।
সবুজে মোড়ানো সম্ভাবনাময় সীমান্তবর্তী এলাকা বাল্লা-টেকারঘাট গ্রামের খোয়াই নদীর চরজুড়ে সাজানো হয়েছে কলা বাগান। এখানে ১২ মাস কলা চাষ হয় বলে সব মৌসুমে কলা পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে দেখা যায় কলা গাছের সবুজ পাতার আড়ালে ঝুলে আছে কাঁচা-পাকা কলার ছড়া। এখানে ইতিপূর্বে তেমন একটা কিছু চাষ হত না, বর্তমানে সেখানে কলার বাম্পার ফলন হয়েছে। এখানকার মানুষ কলা চাষের উপর নির্ভশীল। দিন দিন সেখানে কলা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সময়ের সাথে সাথে এ অঞ্চলে কলা চাষে অর্থনেতিক স্বচ্ছলতার পথে হাঁটছেন এখানকার চাষিরা’। চুনারুঘাটের বিভিন্ন প্রত্যন্ত জনপদ থেকে চায়ের রাজ্যসহ বিভিন্ন আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে বিপুল পরিমাণ কলা বিক্রি হচ্ছে হবিগঞ্জ সিলেটসহ সারা দেশের বিভিন্ন হাট বাজারে। সীমান্তবর্তীর চরাঞ্চলে উৎপাদিত কলা চাষীদের বাগান থেকে স্থানীয় পাইকারদের হাত ধরে এসব চরাঞ্চলের কলা ট্রাক ও পিকআপে বোঝাই করে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে নিয়ে যান পাইকারি ব্যবসায়ীরা। আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতার ফলে চরাঞ্চলে দেশীয় কলা চাষের উপযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। এ অঞ্চলের শত বিঘা পতিত জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি কলার চাষ বাড়লেও বাড়েনি কলা চাষে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা।
জানা গেছে, চরাঞ্চলে মাটিভেদে বিভিন্ন জাতের কলার আবাদ হয়। এর মধ্যে দুই জাতের কলার আবাদ হতে দেখা যায়। একটি দেশি জাতের সবরি কলা আর অন্যটি চম্পা কলা। সবরি কলা ও চম্পা কলা ছাড়াও কাঁচ কলার আবাদ হয় এখানে। এ এলাকায় কলা আবাদে কীটনাশক ব্যবহার তেমন একটা হয় না বললেই চলে। তবে কলা চাষীরা নিজেরাই জৈবিক উপায়ে কীটনাশক তৈরী করে ব্যবহার করে থাকেন। কলা এমনিতেই পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। তার ওপর বালাইনাশক ব্যবহার না হওয়ায় এ এলাকার কলা পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ। সারাবছর এসব কলার ফলন পাওয়া গেলেও নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে ফলন মেলে সবচেয়ে বেশি।
কলা চাষে সরকারিভাবে প্রণোদনার দাবি জানিয়ে চাষিরা বলেন, সরকার ধান ও সবজি চাষে কৃষকদের প্রণোদনা দিলেও সীমান্তবর্তী এলাকার খোয়াই নদীর চরাঞ্চলে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা কলা চাষিরা বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। তাদের মতে সরকারি প্রণোদনা দেয়া হলে এ অঞ্চলে কলা চাষ আরো বেশি সম্প্রসারিত হবে।
স্থানীয় আসামপাড়া বাজারে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা জানান, সারাবছরই তারা এ বাজার থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ আশেপাশের জেলায় কলা নিয়ে যান। এসব চরাঞ্চলের কলার চাহিদা বেশি উল্লেখ করে তারা বলেন, করোনার কারণে কলা ব্যবসায় ধস নামলেও এখন তা অনেকটা কেটে গেছে। স্থানীয় বাজারে কমপক্ষে ১ ছড়ি কলা মানভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনেছি। যা সমতলের জেলায় দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হয়। কুমিল্লা থেকে আসা এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘সমতল এলাকার কলা আর চরাঞ্চলের কলার মধ্যে পার্থক্য অনেক। এখানকার কলা আকারে সমতলের কলার চেয়ে অনেক হৃষ্টপুষ্ট। তাই এখানকার কলা নিয়ে বাজারে বসে থাকতে হয় না। এগুলো ক্রেতারা লুফে নেয়।’
বাল্লার টেকারঘাট গ্রামের কলা চাষী ছিদ্দিক আলী, বলেন, আমাদের উৎপাদিত কলা দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোর চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে রফতানি করা হচ্ছে। এ কারণে একদিকে যেমন চাষিরা পাচ্ছেন কলার ন্যায্য মূল্য, অন্যদিকে এ কলার বাগানকে ঘিরে ক্রেতা, বিক্রেতা ও স্থানীয় কলা ব্যবসায়ীসহ বেশ কয়েকটি পরিবার স্বচ্ছল জীবন যাপন করছেন। স্থানীয় সমাজসেবক জহিরুল ইসলাম উস্তার জানান, অধিক লাভবান অর্থকরী ফসল হিসেবে কলা চাষকে বেছে নিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। ফলে এ কলা চাষ কৃষকের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এবং তিনি বলেন, কলা চাষে সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে কৃষকরা আরো উন্নতির দিকে যাবে ও স্বাবলম্বী হবে।
উপজেলার টেকারঘাট গ্রামের কলা চাষী আব্দুস সত্তার জানান, জমিতে চারা রোপণের ৯ থেকে ১০ মাস পর ফলন আসতে শুরু হয়। একবার রোপণ করলে ওই গাছ ও তার পাশে গজিয়ে ওঠা গাছ থেকে বার বার ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতি বিঘা জমিতে মাত্র ৩০ হাজার টাকা খরচ করে লক্ষাধিক টাকার কলা বিক্রি করা সম্ভব। তবে চাষিদের অভিযোগ, কলা চাষ লাভজনক খাত হলেও একে উৎসাহিত করতে শুধুমাত্র পরামর্শ ছাড়া, সরকার বা কৃষি অফিস থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা তারা পান না। তারা আরও জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে অধিক পরিমাণ কলা চাষে আগ্রহী হতেন কৃষকরা। এর ফলে স্থানীয়ভাবে চাহিদা মিটিয়ে একটি রফতানিযোগ্য পণ্য হিসেবে রাজস্ব খাতে যুক্ত হতে পারে বিরাট অঙ্কের টাকা।
টেকারঘাট গ্রামের কলা চাষি আব্দুস সালাম জানান, গত বছর ২ বিঘা জমিতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে কলা চাষ করে ২ লক্ষাধিক টাকার কলা বিক্রি করেছি। এ বছর ৫ বিঘায় কলা চাষ করেছি। এতে আমার খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা। এবার ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার কলা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। উপজেলার আদর্শ কলা চাষি খেলু মিয়া ও আব্দুল কাদির বলেন, এ বছর তারা ৪ বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছেন। এতে তারা অনেক লাভবান হবেন বলে আশাবাদী। তারা জানান, এখানকার কলা সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম জানান, এ উপজেলায় গত মৌসুমে যেখানে কলা চাষ হয়েছিল ৫০ থেকে ৬০ বিঘা জমিতে। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১‘শত বিঘা জমিতে। অধিক লাভজনক হওয়ায় এখানকার কৃষকরা কলা চাষে ঝুঁকছেন। এতে উপজেলায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কলা চাষ। তিনি বলেন, আমি শুধু তাদেরকে পরামর্শ দিতে পারি কিন্তু আমাদের সরকারের কৃষি বিভাগে কলা চাষে কোন বরাদ্দ নাই। তাই প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিকট আবেদন এলাকার কৃষকদের কথা চিন্তা করে কলা চাষে যাতে কৃষি বরাদ্দ দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, গাজীপুর ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তীতে আছে খোয়াই নদী, খোয়াই নদীতে যদি সেচের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে অত্র ইউনিয়নে সূর্যমুখী, সরিষা ও ভূট্টাসহ অন্যান্য ফসল আবাদ সম্প্রসারণ করতে পারব। আমি তাদেরকে কলা সহ বিভিন্ন ফসল চাষের জন্য সবসময় পরামর্শ দিয়ে আসছি।