হিজরি নববর্ষ : বয়ে আনুক করোনামুক্ত পৃথিবীর এক নতুন পয়গাম

81

এহসান বিন মুজাহির

বিদায় ইসলামি আরবি বছর ১৪৪১। স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪২ হিজরি। ইসলামে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ হিজরি সন এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের রোজা, হজ্ব, ঈদ, শবে বরাত, শবে ক্বদর, শবে মেরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের অনুসারী। ইসলামি আরবি বর্ষপঞ্জিকার সাথে জড়িয়ে আছে প্রিয় নবীজির হিজরতের স্মৃতি, তাই যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের কাছে হিজরি সাল এক সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজকাল তা কেবল রমজান ও ঈদের হিসাব রাখার মধ্যে সীমিত হয়ে আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হিজরি সনের পহেলা মাস মহররম একের পর এক আমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয় ঠিক, কিন্তু হিজরি সনের শুভ আগমন উপলক্ষে হৈ চৈ নেই, নেই কোনো প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়ার বিশেষ কোনো আয়োজন। যেমনভাবে বিশেষ আয়োজন পরিলক্ষিত হয় ঈসায়ি নববর্ষের আগমনে। বাংলা এবং ইংরেজি নববর্ষকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করা হয়, তাতে মনে হয় হিজরি নববর্ষের যেন আমাদের কোনো প্রয়োজনই নেই! অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্বসহকারে পালন করাই ছিল আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কাম্য। হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসূল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরত থেকেই হিজরি সনের সূচনা।
হিজরি সনের সূচনা : খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদির নথি ও দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্ণররা বিপাকে ও অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না। রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল কার্যাদি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন সন প্রবর্তন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্ণর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফা ওমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সম্বলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোনো চিঠি কোন দিনের তা নিরুপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদেরকে নির্দেশ কার্যকর করতে খুব কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রতবোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে। হযরত আবু মুসা আশআরির চিঠি পেয়ে হযরত ওমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শ সভার আহবান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামী তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। উক্ত পরামর্শ সভায় হযরত উসমান (রা.), হযরত আলীসহ (রা.) শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত সকলের পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে এ সভায় ওমর (রা.) সিদ্ধান্ত দেন ইসলামী সন প্রবর্তনের। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে তা নিয়ে পরস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষণ করে রাসূল (সা.) এর জন্মের মাস রবিউল আউয়াল থেকে বর্ষ শুর। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসূলের (সা.) ইন্তেকালের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। কারো কারো মতে হুজুর (সা.) এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। কেউ বললেন নবী (সা.) এর নবুয়ত প্রকাশের বছর থেকে বর্ষগণনা শুরু করা যায়। এভাবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হযরত ওমর (রা.) বললেন নবী (সা.) এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মের মাস থেকেই খ্রিস্টাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসূলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিস্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্যতা হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য পরিতাজ্য। আর অপরদিকে নবীজীর (সা.) ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে প্রিয় নবীজীর (সা.) এর মৃত্যু ব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলাম বিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন ঘটবে। হযরত ওমর (রা.) এর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যকে হযরত উসমান (রা.), হযরত আলী (রা.) একবাক্যে সহমত পোষণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে অবশেষে মহানবী (সা.) এর হিজরতের ঘটনাকে মহিমান্বিত করার জন্য মহররম মাস থেকে হিজরি নামে একটি স্বতন্ত্র সন চালু করার ঘোষণা দেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.)। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হিজরী সনের মাস সমূহ মুসলমানদের জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে।
ইসলামে হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ইসলামে হিজরী সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসেবের মাস হলো বারোটি। (মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানী, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানী, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলক্বদ এবং জিলহজ্ব) যেদিন থেকে তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত। (সূরা তাওবাহ : ৩৬)। বারো মাস হলো মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জুলক্বদ ও জুলহজ্ব। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব। (তাফসিরে বাগাভি ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা নং :৪৪)।
আর হিজরি সনের প্রথম মাস হলো মহররম। মহররম একটি তাৎপর্যমন্ডিত এবং বরকতময় মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কুরআন কারীমে এ মাসটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ছয়ত্রিশ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মহররম’। এ আয়াতের চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্বের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলক্বদ, জিলহজ্ব ও মহররম এবং অপরটি হলো রজব। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
কুরআনেও আরও এরশাদ হয়েছে, লোকেরা তোমাকে নতুন চাঁদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। বলো ‘তা মানুষ ও হজ্বের জন্য সময় নির্দেশক। (সূরা বাকারা : ১৮৯)। কুরআনে আল্লাহ আরও বলেন-তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন-যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। যাতে জ্ঞানী লোকেরা তাঁর নিদর্শন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে’। (সূরা ইউনুস : ৫)। মহান অল্লাহ আরো বলেন, ‘আল্লাহ ঊর্ধ্বদেশে আকাশমন্ডলী কোনরূপ স্তম্ভ ছাড়াই স্থাপন করেছেন, তোমরা তা দেখতে পাও, অতপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন, এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করলেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।’ (সূরা রাদ : ২)। মহররম মাসেই সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক কারবালা। এ মাসে রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’। মানবজাতির পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহ্য বহন করছে মহররম মাস। কাজেই মুসলিম উম্মাহর কাছে হিজরি সনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষ করে হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে থাকার কারণে এই সনের তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। এই চাঁদের হিসাবে মুসলমানদের অনেক ইবাদত বন্দেগি, আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। কাজেই হিজরি তারিখকে গুরুত্ব দেয়া একান্ত জরুরি।
হিজরি নববর্ষ ১৪৪২ বয়ে আনুক করোনামুক্ত পৃথিবীর এক নতুন পয়গাম।