বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আলহাজ্ব আজিজুর রহমানের দাফন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন

21
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আলহাজ্ব আজিজুর রহমানের দাফন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
সাবেক গণপরিষদ সদস্য, সাবেক দুই বারের সংসদ সদস্য, সাবেক হুইপ, বাংলাদেশ সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আলহাজ্ব আজিজুর রহমানের দাফন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র:) টাউন ঈদগাহ মাঠে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কয়েক হাজারা মানুষের উপস্থিতিতে নামাজে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হয়। তার আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
জানাযার নামাজ পূর্বে তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমানের পরিচালনায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নেছার আহমদ, জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, মরহুমের ছোট ভাই জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার মো. জামাল উদ্দিন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ সুপার ফারুক আহমদ, সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমান, সাবেক এমপি অ্যাড নওয়াব আলী আব্বাস খান, পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. ফজলুর রহমান, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. কামাল হোসেন প্রমুখ।
টাউন ঈদগাহে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও নামাজে জানাযা শেষে গুজারাই পারিবারিক কবরস্থানে মা বাবার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
মন্ত্রী ও এমপিদের শোক : আজিজুর রহমানের মৃত্যুতে পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন মৌলভীবাজার-১ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ও বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পবিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক ঢাকসুর ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নেছার আহমদ,মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ এমপিসহ জেলা প্রশাসন, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, জন প্রতিনিধি, রাজনীতিবীদ, সামাজিক, পেশাজীবী, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব ,সাংবাদিক সমিতি জেলা ইউনিট, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃববৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ।
আজিজুর রহমানের কর্মজীবন : আজিজুর রহমান ১৯৪৩ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গুজারাই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম আব্দুল সত্তার, মাতা মরহুম কাঞ্চন বিবি। তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন শ্রীনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ সালে মৌলভীবাজার কলেজ থেকে আইকম পাশ করেন এবং হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজ থেকে বি-কম পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম কম পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে তিনি সবচেয়ে কম বয়সী এমপি ছিলেন। এরপর ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে টানা দুই বার মৌলভীবাজার-৩(সদর-রাজনগর)আসন থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় হুইপ ও কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি শুধু মুক্তিযদ্ধকালীন সময়ে একাধিকবার পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পাক হানাদারদের হাতে নির্যাতনের শিকার একজন যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অন্যতম রসদ সরবরাহকারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশনায় ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কারাবরণ করেন। এরপর একই বছরের ৭ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জেল ভেঙ্গে সিলেট কারাগার থেকে তাকে মুক্ত করা হয়।
২মে পুনরায় পাকবাহিনী মৌলভীবাজার শহরে প্রবেশ করে বর্বরোচিত দমন পীড়ন চালানোর পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। এক পর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আহুত পশ্চিমবঙ্গের বাগডুগায় (দার্জিলিং) প্রথম পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগদান করেন আজিজুর রহমান। প্রবাসী সরকার কর্তৃক আয়োজিত সামরিক প্রশিক্ষণে সিলেট বিভাগের একমাত্র প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবং গণপরিষদ সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর শমসেরনগর, ৬ ডিসেম্বর রাজনগর এবং ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মৌলভীবাজারকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন চিরকুমার আজিজুর রহমান।
সূত্রমতে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকবাহিনী গুজারাই গ্রামের বাড়ির টংগিঘর থেকে ধরে নিয়ে শহরের পিটিআই সংলগ্ন টিলায় পাকবাহিনীর বাংকারে নিয়ে আজিজুর রহমানকে অমানবিক শারীরিক নির্যাতনে অঙ্গহানি করে।
আজিজুর রহমান, আজন্ম প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক অহিংস রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিকমনা একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন।
তিনি যেকোন দুর্যোগে মানুষের পাশে থেকে সহায়তা ও সাহস যুগিয়েছেন। ঝড়বৃষ্টি বন্যা,নদী ভাঙ্গনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাত দিন মানুষের সহায়তার কাজ করেন।
তিনি মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ পাওয়ার পর সফলতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
গণপরিষদের এই সদস্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য রচিত সংবিধানের একজন স্বাক্ষরকারী।
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীতে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন।
তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ মৌলভীবাজার জেলা শাখার দুইবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলায় ১৪ দল ও মহাজোটের সমন্বয়কারী ছিলেন।
দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদকে মনোনীত হন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপনমূলে মৌলভীবাজারে প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন আজিজুর রহমান।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত: মঙ্গলবার ১৮ আগস্ট রাতে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন)। ঢাকা থেকে দূপুরে তার লাশ নিজ বাড়ি সদর উপজেলার গুজারাইয়ে পৌঁছায়। করোনা আক্রান্ত হয়ে গত ৫ আগষ্ট তিনি বিএসএমএমইউ-তে ভর্তি হন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে মৌলভীবাজার থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীনবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার মরদেহ নিজ বাড়িতে পৌঁছালে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে প্রিয় এ নেতাকে এক নজর দেখতে জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীরা ছুটে আসেন তার বাড়িতে। মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় তার কর্মস্থল জেলা পরিষদে মরদেহ নেয়া হয়। লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা।