সিলেটের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা বন্যা কবলিত, মিনিটে মিনিটে বাড়ছে পানি

7
পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে আবারো সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। ছবিটি শনিবার বিকেলে জৈন্তাপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি- মামুন হোসেন

স্টাফ রিপোর্টার :
টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ী অব্যাহত ঢলে উজান থেকে নেমে আসা নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সুরমা নদীর পানি ফুলে ফেঁপে উঠে বিভিন্ন ছাড়া-ড্রেন দিয়ে মহানগরীর বিভিন্ন এলকায় ঢুকে পড়েছে পানি। গতকাল শনিবার নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এমন চিত্র দেখা গেছে। সুরমা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বাসা বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকেছে। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসী।

কানাইঘাটে বন্যা দেখা দেয়ায় অনেক বাড়ি ঘরে ঢুকে পড়েছে পানি।

সুরমা নদীতে এসে মিশেছে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিল। ফলে এসকল নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি এসে যুক্ত হচ্ছে সুরমা নদীতে। তাছাড়া গত দুই দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সুরমা নদী এখন পানিতে ভরপুর।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নগরীর তালতলা, সুরমা নদীর তীরের ছড়ারপাড়, মাছিমপুর, শেখঘাট, কাজির বাজার, জল্লারপার, পুরানলেনসহ বিভিন্ন এলাকার একাধিক কলোনি ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার নিন্মাঞ্চল বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সড়কে উঠেছে পানি। নগরীর ব্যস্ততম এলাকা তালতলাস্থ পয়েন্ট ও গুলশান হোটেলের সামনে এবং মাহমুদ শাহ শপিং সেন্টারের নিচ তলায় পানি উঠতে দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ড্রেন ও ছড়ার দূষিত ময়লা পানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকছে। এ পানিতে দুর্গন্ধও আছে। ফলে এ পানি থেকে নানা রোগ হতে পারে।
ভুক্তভোগীরা জানান, নগরীর বিভিন্ন ছড়া, খাল ও ড্রেনের পানি গিয়ে পড়ে সুরমা নদীতে। বর্তমানে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি উঠেছে।
এদিকে, কুশিয়ারা নদীর আমনসিদ, শেওলা পয়েন্ট ও সুরমা নদীর কানাইঘাট, কীন ব্রীজের পয়েন্টসহ সব কয়েকটি পয়েন্টে নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারীবর্ষণ আর পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকলে নতুন নতুন এলাকা আরো প্লাবিত হতে পারে।
বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে প্রতিনিধিরা বন্যার সর্বশেষ খবর পাঠিয়েছেন।
বাবরুল হাসান বাবলু তাহিরপুর থেকে জানিয়েছেন : তাহিরপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি। ৫ ইউনিয়নে শতাধিক গ্রাম পানি বন্দী। বন্যা কবলিত ২০ হাজার পরিবার। পাহাড়ি ঢলের পানিতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত। ৫ ইউনিয়নে প্রতিটিতে খোলা হয়েছে বন্যাশ্রয় কেন্দ্র। বন্যাশ্রয় কেন্দ্র উঠছে বন্যা কবলিত লোকজন।
ভারতের মেঘালয় সহ সুনামগঞ্জ জেলায় গত দু’দিন ধরে মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টিতে বন্যা দেখা দিয়েছে হাওর উপজেলা তাহিরপুরে। সেই সাথে ঝড়ো বাতাসে সৃষ্ট ঢেউয়ে ভাঙ্গছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। পানির নীচে তাহিরপুর বাদাঘাট সড়ক। জেলা সদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। পানির স্রোতে স্থানে স্থানে ভেঙ্গে গেছে তাহিরপুর সুনামগঞ্জ। উপজেলা পরিষদ ভবন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন এলাকা সহ বিভিন্ন হাটবাজারে পানি। পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে ঘরবাড়ি, অফিস আদালত, দোকান পাট।

ছাতকের বিভিন্ন সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

গত ২৭ জুন হতে প্রথম দফা বন্যা কবলিত হয় হাওর উপজেলা তাহিরপুর। এর রেশ কাটতে না কাটতে আবারও নতুন করে বন্যা আক্রান্ত হয় তাহিরপুর। এতেপানি বন্ধী হয়ে পরে শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী। আর এতে বেশী দুর্ভোগে পরে খেটে খাওয়া লোকজন।
ইতি মধ্যে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে দক্ষিণকুল, মাহতাবপুর, চিকসা, বালিজুরী, পাতারি, তিওরজালাল, সীমানা, পাতারগাঁও, হোসেনপুর, আনোয়ারপু,তাহিরপুর, গোবিন্দশ্রী, শ্রীপুর, জয়নগর, রামসিংহপুর, মাড়ালা, পনডুপ, নওগাঁ, সোলেমানপুর, আনন্দনগর, উমেদপুর, জয়পুর, কাউকান্দি, বড়দল, মন্দিয়াতা, গোলকপুর, কামাড়কান্দি, জামালগড়, জামলাবাজ, ঠাকাঠুকিয়া, রসুলপুর, রতনশ্রী সহ শতাধিক গ্রাম।
উজান তাহিরপুর দক্ষিণ হাটি গ্রামের কৃষক ইউনুছ মিয়া তিনি জানান, শুক্রবার বিকেলে ঝড়ো বাতাসে শনি হাওরে ঢেউয়ে তার বসত ঘরটি ভেঙ্গে যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকার ফার্মেসী ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিন জানান, শুক্রবার রাত থেকেই তার ফার্মেসী ঘরের ভেতরে পানি প্রবেশ করে। তড়িঘড়ি করে মালামাল সরাতে গিয়ে কিছু মালামাল ক্ষতি হয় বলে তিনি জানান।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস উপ-সহকারী প্রকৌশলী সুব্রত দাস বলেন, দ্বিতীয় দফা বন্যায় উপজেলার ৭ ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নে ১৮ হাজারের বেশী পরিবার বন্য কবলিত হয়েছে। ইতি মধ্যে বেশ কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে বন্যা কবলিত লোকজন উঠছে। আমরা তাদের খোঁজ খবর রাখছি।
তাহিরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: সুমন বর্মন বলেন, বাসার নীচে পানি, নৌকা করে অফিস আসা যাওয়া করতে হচ্ছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদ্মাসন সিংহ বলেন, আমি বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখেছি, অনেক গ্রামে বাড়ি আঙ্গিনায় বন্যার পানি প্রবেশ করছে, আমি বন্যা কবলিত লোকজনদের খোঁজ খবর নিচ্ছি। সেই সাথে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা কবলিত লোকজনদের শুকনো খাবার দেয়ার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছি।
কানাইঘাট থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : টানা ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকা সহ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারনে কানাইঘাটে উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে করে অনেক মৎস্য খামার, কয়েকশত হেক্টর আমন ধানের বীজতলা পুরোপুরি ভাবে তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে নিম্নাঞ্চলের অনেক গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শত শত মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অনেকের বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়নি। শনিবার সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার

জামালগঞ্জে ঢলের পানি ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছে।

৬৮ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুরমা-লোভা সহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বাড়ার খবর পাওয়া গেছে।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্বাহী কর্মকর্তা বারিউল করিম খান বন্যা পরিস্থিতি প্রতিদিন মনিটরিং করছেন বলে জানা গেছে।
একে কুদরত পাশা সুনামগঞ্জ থেকে জানিয়েছেন : ভারতে পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের ফলে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার আরও ২৯ সেন্টিমিটার বেড়ে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হতে শুরু করেছে নদী তীরবর্তী বাড়িঘর ও দোকানপাট। শনিবার (১১ জুলাই) সকালে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা শুক্রবার (১০ জুলাই) রাত পর্যন্ত ছিল ২৫ সেন্টিমিটার।
শহরের উকিলপাড়া থেকে দাড়ারগাঁও পর্যন্ত রাস্তা পানিতে নিমজ্জিত। সুরমার পানি শহরের প্রবেশ করে মানুষের বাসাবাড়ী প্লাবিত করেছে। উঁচু স্থানের সন্ধানে চলছে মানুষ। ইতিমধ্যে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। শহরের নবীনগর, ধোপাখালী, ষোলঘর, বনানীপাড়া, আলীপাড়া, মোহাম্মদপুর, হাছননগর, হাসনবসত, সুলতানপুর, সাহেববাড়ী ঘাট, আরফিননগর, হাজীপাড়া, নতুনপাড়ায় সহ অনেক পাড়ায় পানি উঠেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের ফলে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ও যাদুকাটা নদীর পানি বিপদ সীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৩৩ মিলিমিটার। টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সহিবুর রহমান জানান, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাত থেকে আরও ২৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সকালে ৫৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে।

তাহিরপুরে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত তাহিরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর আঙ্গিনা।