সিয়াম সাধনার মাস

18

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ত্যাগ কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাস রমজানের আজ উনিশতম দিবস। আগামীকাল থেকে শুরু হবে আরেক বিশেষ প্রশিক্ষণের পিরিয়ড ইতিকাফ সাধনা। গতকাল আমরা এ কলামে করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবেলায় সকলকে আর্ত মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ করানোর চেষ্টা করেছি। আজও সে সম্পর্কে দু’চার কথা ও আরজ। যুগে যুগে অভাব-অনটন, দুঃখ-দরিদ্র, বিপদ-আপদে সাহায্য করাই ছিল সমাজ কল্যাণের পয়লা নম্বর কাজ। বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা পারলৌকিক মুক্তির আশায় সমাজের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে কাজ করতেন। বিভিন্ন ধর্মের পীর-ফকির, মুর্শীদ, যাজক, পুরোহিত ও ভিক্ষুদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডার মাধ্যমে সমাজকল্যাণমূলক কাজ করছেন। হিন্দু ধর্মের বদান্যতা, বৌদ্ধ ধর্মে জীবপ্রেম, খ্রীস্টান ধর্মে চ্যারিটি এবং ইসলাম ধর্মে দানশীলতার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। হযরত মুহম্মদ (স) কত সুন্দর করে বলেছেনÑ যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেট ভরে খায় সে প্রকৃত মুসলমান নয়।’
বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং রাজা হর্ষবর্ধনের এরূপ এক দান বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে যে, সমস্ত সম্পদ বিতরণ শেষে হর্ষবর্ধন তার রাজকীয় পোশাক ও অলঙ্কারাদি বিতরণ করে দিয়ে এ বলে তৃপ্তিলাভ করেন যে, তার সমস্ত সম্পদ পারমার্থিক কাজে ব্যয় হয়েছে’। ভারতীয় মুসলিম মনীষীগণ তাদের বিভিন্ন কিতাবে এ হিন্দু রাজার নানাবিধ মানবিক গুণাবলীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
বৌদ্ধ ধর্মের মূল্যবোধগুলোর মধ্যে আছে মানুষে মানুষে কোন মতভেদ নেই। জাতি, ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। জীবে দয়া ও অহিংসা পরমধর্ম। প্রেম-দান-দয়া ইত্যাদি সৎকর্মের মাধ্যমে সৌন্দর্য্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করা বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের প্রধান কাজ। পাশাপাশি খ্রিস্টধর্মের মূল্যবোধগুলো লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে, সেখানেও মানবতার সেবার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বলা হয়েছে, খোদার রাজ্যে সবই সমান। অহিংসা মানবতাবোধ এবং ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর এ ধর্ম যথেষ্ট গুরুত্বদান করেছে। খিস্টানধর্মে দানশীলতাকে ¯্রষ্টার নৈকট্য, করুণা এবং পরকালে আত্মার মুক্তিলাভের এক বিশেষ উপায় বলে বিবেচনা করা হয়েছে। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে দানশীলতার মূল অনুপ্রেরণা ছিল খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয় অনুশাসন। ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রচারে এ ধর্মে বলা হয়েছে- সূচের ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে উটের গমনাগমন সম্ভব হলেও বেহিসাবী ধনীদের খোদার রাজ্যে প্রবেশ সম্ভব হবে না।’
যীশু বলতেন: সৃষ্টির সেবা অর্থ বিশ্ব পালকের সেবা।
পরিশেষে বলি, তাবৎ ইতিহাসের ক্রমধারা এটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, দুনিয়ার যাবতীয় মানবতাবাদী ধর্ম, মহাপুরুষদের দেখানো পথ ও মত সবগুলো যে বিষয়টিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে- তা হলো অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অর্থনৈতিক শোষণ-নিপীড়ন, অভাব-অনটন বৈষম্যের দৈন্য দূর করা আর্তমানবতার মুখে হাসি ফোটানো। আজকে আমরা সবাই কোন না কোন ধর্ম ও আদর্শে বিশ্বাসী, কিন্তু সে ধর্ম ও আদর্শ আমাদের স্ব-স্ব দৈনন্দিন জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে? পক্ষান্তরে আমরা আদর্শিক পথ থেকে দূরে বহুদূরে অবস্থান করছি। ধর্মীয় মহানুভবতা আমাদের জীবনে অনুপস্থিত থাকার কারণে আমরা আজ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হানাহানি ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। ফলে মানুষ হিসেবে সমাজকে আদর্শিক সুখী ও সমৃদ্ধশালী হিসেবে গড়ে তোলার আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ ছিল তা পালন করার অবসর মিলছে না, যার পরিণামে সর্বত্র আজ হিংসা-বিদ্বেষ ও ধর্মীয় কোন্দল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে গুমড়ে কাঁদছে হতভাগা জাতি। পারস্পরিক সহ-অবস্থানের মাধ্যমে সমাজ সেবা দেশ গড়ার ঐতিহ্যম-িত রাজপথ ধরে আমরা কি অগ্রসর হতে পারি না হতাশাগ্রস্ত জাতির মুখে হাসি ফোটাতে ?