সিয়াম সাধনার মাস

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ আঠারো রমজানুল মোবারক। এখন মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়। বিশ্বময় ‘করোনা’ প্রাদুর্ভাবে তছনছ হওয়া দুঃখী মানুষ ও প্রকৃতির পাশে নিঃসঙ্কোচ দাঁড়ানোর সময়। এ শিক্ষা ত্যাগের মাস রমজানের, এ শিক্ষা যুগে যুগে আদর্শ ধর্ম ও সভ্যতার। প্রাচীনকাল হতেই সকল দেশের মানুষের একটা বৃহৎ অংশ বিপদ-আপদ, দুঃখ-দরিদ্র, ক্ষুধা, অভাব-অনটনে কষ্ট ভোগ করে আসছে। অন্যদিকে সমাজের অন্য একটি অংশ আরাম-আয়েশ ও আনন্দ-আমোদে দিন কাটাচ্ছে ও সহায় সম্পদের অধিকারী হয়ে দেদার ভোগ-বিলাসে কালাতিপাত করে আসছে। সমাজের বিত্তশালী পরোপকারী ও মহৎ ব্যক্তিরা মানবিক অনুভূতিতে তাড়িত হয়ে এবং ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিপদগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করে থাকে। যুগে যুগে অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য, বিপদ-আপদে সাহায্য করাই ছিল সমাজ কল্যাণের পহেলা নম্বর কাজ। বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা পারলৌকিক মুক্তির আশায় সমাজের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে কাজ করতেন। বিভিন্ন ধর্মের পীর-ফকির, মুর্শীদ, যাজক, পুরোহিত ও ভিক্ষুদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডার মাধ্যমে সমাজকল্যাণমূলক কাজ করছেন। হিন্দু ধর্মের বদান্যতা, বৌদ্ধ ধর্মে জীবপ্রেম, খ্রীস্টান ধর্মে চ্যারিটি এবং ইসলাম ধর্মে দানশীলতার ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ‘হযরত মুহম্মদ (স.) কত সুন্দর বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেট ভরে খায় সে প্রকৃত মুসলমান নয়।’
সুখী ও আদর্শ সমাজ জীবনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে- মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক দ্বারা একে অন্যকে সাহায্য করা। ইসলাম ধর্মও এ নীতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তুলে ইসলাম যে সাম্য ও সহমর্মিতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তা খুবই বিরল। ইসলাম ছোট বড় সবার জন্যই তার সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে। হযরত মুহম্মদ (স.) বলেন, সমাজ সেবা সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাজ। রাসূলে খোদা (স.) আরও বলেছেন, গোটা সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার (পালিত)। আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম সৃষ্টি সে যে তাঁর পরিবারের (সদস্যদের) সঙ্গে সদাচার করে ( মেশকাত প-২১৭)। ইসলাম মানুষের কর্তব্য বা দায়িত্বকে দু’ভাগে ভাগ করেছে ১. স্রষ্টার সাথে মানুষের কর্তব্য, ২. সৃষ্টির প্রতি সৃষ্টির দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ইসলাম মানব কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রথা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। যাকাত, বায়তুল মাল, ওয়াকফ ইত্যাদি আর্থসামাজিক কল্যাণধর্মী কর্মকা-ের অবদান অনস্বীকার্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে সব এতিমখানা, সরাইখানা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, র্ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সে সবের পেছনে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে।
ইসলামী জীবন যাত্রায় যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে ধনী গরিবের সমতা বিধানের জন্য যাকাত একটি কল্যাণমূলক ব্যবস্থা। সমাজের বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাও যাকাত প্রবর্তনের একটি প্রধান লক্ষ্য। যাকাত ধনী ব্যক্তির দ্বারা গরিবের প্রতি কোন অনুকম্পা প্রদর্শন নয়, বরং এটা গরিবের হক। উল্লেখ্য, জীবন যাত্রার জন্য নিজস্ব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ব্যয়-বাদে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সমমূল্যের মাল বা অর্থ বছরান্তে উদ্বৃত্ত থাকলে ওই সোনা/রুপা কিংবা এর মূল্যের ৪০ ভাগের একভাগ যাকাত দেয়া ফরজ। সুতরাং বলা যায়, সমাজ জীবনে ন্যায়, অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠা আর সামগ্রিক কল্যাণ কামনাই ইসলামের মূল কথা।
হিন্দু ধর্মের মূল্যবোধগুলোও পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সমাজসেবা ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে হিন্দু ধর্ম যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘দুস্থ ও আর্তমানুষের মাঝেই ভগবান অবস্থান করেন। তাই তাদের সেবা করেই ভগবানকে তুষ্ট করা সম্ভব।’
তাই আমরা যে যে ধর্মেরই হই না কেন আমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ানো মাহে রমজানের পয়গাম। দান ও সেবার নামে ফটোসেশন নয়। এটি বিপদকালীন পরিবেশের সঙ্গে ঠাট্টার নামান্তর।