সিয়াম সাধনার মাস

18

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্ব সভ্যতাকে রণক্ষেত্রের চরম মুহূর্তে মহানুভবতা শিক্ষা দানের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত আজ সতেরো রমজান বদর দিবস। বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা এবং মুসলমানদের প্রথম সামরিক বিজয়। মাত্র তিন শ’ তেরোজন জিন্দাদিল মর্দে মুমিন সেদিন প্রতিপক্ষেয় এক হাজার দুশমন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে যে অলৌকিক বিজয় অর্জন করেছিলেন তা জগতের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর অধ্যায়ের সূচনা করে। এটি ছিল ২য় হিজরীর ঘটনা। হিজরত-উত্তর
মদিনায় ইসলামের ক্রমোন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং আবু সুফিয়ানের মিথ্যা রটনায় প্রলুব্ধ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার দুরভিসন্ধিতে মক্কার কাফিররা এ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। ফলাফল হয়েছে তার উল্টো। বিজয় এসেছিল মুসলমানদের ঘরে।
ঘটনাটি ছিল এমন : কাফিরদের রণ প্রস্তুতিসহ মদিনাভিমুখে অগ্রসরমান অবস্থা জানতে পেরে আঁ হযরত (স) যুদ্ধ সংক্রান্ত পরামর্শসভা আহ্বান করেন। বিস্তারিত আলোচনা পর্যালোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ মোতাবেক ১৭ রমজান তারিখে ৩১৩ জনের একটি ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রেরিত হয়। বদর উপত্যকায় দুই বাহিনীর সংঘর্ষ বাঁধে। হযরত মুহম্মদ (স) স্বয়ং য্দ্ধু পরিচালনা করে অনুপ্রেরণা দান করেন। আল-আরিসা পাহাড়ের পাদদেশে মুসলিম শিবির স্থাপিত হয় এবং এর ফলে পানির কূপগুলো তাদের তত্ত্বাবধানে আসে। আল ওয়াকিদী বলেন, হযরত মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য এমন একটা স্থান বেছে নেন, যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ শুরু হলে কোন মুসলমান সৈন্যের চোখে সূর্য কিরণ বিঘ্ন ঘটাবে না। প্রথমে প্রাচীন আরব রেওয়াজ অনুসারে মল্লযুদ্ধ হয়। মহানবীর নির্দেশে হযরত আমীর হামজা, হযরত আলী ও আবু উবায়দা (রা) কুরাইশ পক্ষের নেতা উতবা, শায়বা ও ওয়ালিদ বিন উতবার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এতে শত্রু পক্ষীয় নেতৃবৃন্দ শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হয়।
উপায়ন্তর না দেখে আবু জেহেল বিধর্মী কুরাইশ বাহিনীসহ মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মুসলমানদের প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু চরম প্রতিকূল অবস্থায় সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করা বিধর্মী কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অসামান্য রণনৈপুণ্য, অপূর্ব বিক্রম ও অপরিসীম নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে মুসলমানরা বদরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে কাফিরদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এ যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয় এবং সমসংখ্যক বন্দী হয় অপরদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাৎ বরণ করেন।
ইসলামের প্রথম সামরিক বিজয় বদর যুদ্ধের প্রতিটি দিক ও বিভাগই যেন উম্মতে মুসলিম এবং বিশ্ব সভ্যতার ভান্ডারে একেকটি শিক্ষার স্বাক্ষর। সেদিন মহান পয়গম্বরে খোদা (স) যুদ্ধবন্দীদের প্রতি যে উদার ও মধুর আচরণ করেছেন তা সত্যিই প্রতীকী দৃষ্টান্ত। ঐতিহাসিক মুইর সেদিনকার এক যুদ্ধবন্দীর জবানীতেই রাসুল ও তার সাহাবীদের মহানুভবতার বিবরণ দিয়েছেন: মদিনাবাসীর ওপর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, তারা আমাদের উটে বা ঘোড়ায় চড়তে দিয়ে নিজেরা হেঁটে চলত। তারা নিজেদের সামান্য রুটিও নিজেরা না খেয়ে আমাদের খেতে দিত, নিজেরা খোরমা খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত করত। হযরত (স) তাদের আহার-বস্ত্র-বাসস্থানের গ্যারান্টি দিলেন এবং মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্তি প্রদানের ব্যবস্থা করলেন। উপরন্তু যারা মুক্তিপণ দিতে অক্ষম তাদের মুসলমানদের বিরোধিতা না করার প্রতিশ্রুতিপূর্বক কিংবা মুসলমান শিশু-কিশোরদের তালিম দেয়ার অঙ্গীকারে মুক্তি দেয়া হয়।
বস্তুত বদর যুদ্ধ ইতিহাসে এক যুগ প্রবর্তক ঘটনা। যে সমস্ত মুসলিম বীর জঙ্গে বদরে যুদ্ধ করেছিলেন পরবর্তীকালে তারা আরও অনেক বড় বড় যুদ্ধে অংশ নেন। অনেক দেশ জয় করেন। কিন্তু সেসব জয়-গৌরবকে কোন মূল্য না দিয়ে বদর যুদ্ধে জড়িত থাকাকেই সৌভাগ্য বলে মনে করতেন। ইরাকের শাসনকর্তা, কুফা নগরীর স্থপতি, পারস্য বিজয়ী মহাবীর সাদ অশীতিবর্ষ বয়সে মরণ শয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেছিলেন, বদর যুদ্ধে পরিহিত বর্ম আমার পরিয়ে দাও, এই বেশে মরব বলে আমি এটি সযত্নে তুলে রেখেছি।
আজ আমরা সিয়ামের মাসে সেই গর্বিত ঘটনা ও মহাত্মা নূর নবী (স) ও তার পেয়ারা সাহাবাদের স্মরণ করছি যারা রণক্ষেত্রে শত্রু পক্ষকে মানুষ ভেবেছেন, মনুষত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। কবির ভাষায় কালো আর ধলো বাইরে কেবল; ভেতরে সবার সমান রাঙ্গা। দুর্বলদের শিক্ষা দিয়েছেন নৃশংসতা দিয়ে নয়; পরম ভালবাসায় সিক্ত করে। আজ সে শিষ্টাচার জাতিতে জাতিতে সৃষ্টি হলে অনেক পেরেশানি থেকে বিশ্ব মানবতা মুক্ত থাকত। সেই পয়গাম বদর দিবস আমাদের দিয়ে যাচ্ছে।