জাতীয় শিশু দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন

12

ওবায়দুল মুন্সী

প্রতিবছর ১৭ মার্চ এলেই ফিরে আসে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালের এইদিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বাবা মায়ের দেয়া আদুরে নাম ছিল খোকা। কিশোর বয়সেই শেখ মুজিবের মধ্যে প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, গরীব-অসহায় মানুষের জন্য ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। স্কুলজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। গ্রামের স্কুল থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়েই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। তিনি পড়াশোনার থেকে রাজনীতি বেশি করেছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা তাঁকে বাধা দেননি। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করে জানা যায়, তাঁর বাবা একদিন তাঁকে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি করতে নিষেধ নেই! তবে লেখাপড়া করতে ভুল করো না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হওয়া যায় না। আর একটা কথা মনে রেখ, ংরহপবৎরঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব’ যদি থাকে তবে জীবনে কোনোদিনও পরাজিত হবে না।” বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, বাবার একথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২১) এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই তিনি রাজনীতিতে সফল হয়েছিলেন।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করেই কিশোর মুজিব কলকাতায় যান। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বড় পরিবর্তনগুলো শুরু হয়। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় হন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাসান, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে শেখ মুজিবও ঢাকায় চলে আসেন। নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিশাল জনসভায় ছাত্র জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে সঅবাই সমর্থন জানায়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনগণ প্রায় নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার এই মহান নেতার জন্মদিনে আমরা জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আজকের মুজিববর্ষে, বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না।
সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়- যেখানে ঘুমিয়ে আছো, শুয়ে থাকো বাঙালির মহান জনক তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ শৌর্য আর অমিত সাহস টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো তোমার সাহস নেবে নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা। আজকের তরুণ প্রজন্ম এই মহান নেতার আদর্শ থেকেই দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা লাভ করবে। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে তাদের মাঝেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন জন্ম থেকে জন্মান্তরে।
১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। শিশুদের সাথে গল্প করতেন, খেলা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। বাংলাদেশের জাতীয় শিশু দিবস প্রতি বছর পালিত হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে।
শিশু দিবস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় পালিত হয়। শিশু দিবস পালনকারী প্রথম দেশ তুরস্ক। তুরস্কের অধিবাসীরা শিশু দিবস প্রথম পালন করেন ২৩শে এপ্রিল, ১৯২০ সালে। সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয় ২০শে নভেম্বর এবং ‘আন্তর্জাতিক শিশু দিবস’ পালিত হয় ১ জুন।
বাংলাদেশে জাতীয় শিশু দিবস ১৯৯৬ সালে সরকারিভাবে প্রথম পালন করা হয়।
শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ ছিল অপরিসীম। তাই তাঁর জন্মদিনকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করা হয়। এদিনে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করার নতুন শপথ নিতে হবে।
আজকের শিশুরাই আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ। এজন্য শিশুদের যথাযথ শিক্ষা ও মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে তাদেরকে সেভাবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। অনেক শিশু দরিদ্রতার কারণে তাদের সেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিষিদ্ধ শিশু শ্রমে জড়িয়ে পড়ে। যে বয়সে ওদের লেখাপড়া করার কথা সে বয়সে দারিদ্রতার কারণে বিভিন্ন কলকারখানা, হোটেল, ওয়ার্কার্সপ, দোকানপাট ইত্যাদিতে অমানষিক পরিশ্রমে লিপ্ত থাকে। সবধরনের শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। পরিবার সমাজ তথা রাষ্ট্রকে তাদের দ্বায়িত্ব নিতে হবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে বাস ১৬ কোটি মানুষের। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটিরও বেশি শিশু। তাই শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন অসামান্য গৌরবের। তাঁর এ গৌরবের ইতিহাস থেকে প্রতিটি শিশুর মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তার ভিত্তি গড়ে উঠুক এটাই জাতীয় শিশু দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। সর্বোপরি আজকের শিশুরাই আগামীর সক্ষম নাগরিক। তাই শিশু-কিশোরদের চারিত্রিক দৃঢ়তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য-পুষ্টির দিকে নজর দিয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত হোক আমাদের এ বছরের শিশু দিবসের ভাবনা। পরিশেষে, ছান্দসিক ভাষায়- আজকের শিশুরা
আগামীর কারিগর
সুন্দর করে দেবে
বাংলার বাড়িঘর।
গড়ে দেবো শিশুদের
স্বপ্নীল আবাসন
করে যাবো প্রত্যয়
প্রতিদিন ভাবা সন!