শিক্ষার তাত্ত্বিক জ্ঞানের সর্বোত্তম ও চমৎকার মাধ্যম

48

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
ইলমে তাসাওউফের মাধ্যমে ঈমান দৃঢ় করবার, ইবাদতে জান্নাতী সুখ আনয়ন করবার, প্রিয়নবী (সা.) এর সুন্নত যথাযথভাবে পালন করবার প্রেরণায় উদ্ভাসিত হওয়া যায়। সে কারণে মানব জীবনের সমস্ত কাজকর্ম, ব্যক্তির আচার-আচরণ, ধর্মীয় দায়িত্ব কর্তব্যগুলো পালন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) কে গ্রহণ করতে হয় আদর্শ হিসাবে।
ইলমে তাসাওউফের (অতীন্দ্রিয়বাদ) সঙ্গে অদৃশ্যকে জান অথবা অলৌকিক কার্য সম্পাদন করার কোন সম্পর্ক নেই। অথবা মনোজাগতিক প্রক্রিয়ায় একজনের ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলোকে আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেয়ার রীতির সঙ্গেও এর সংযোগ নেই। এমনকি কঠোর সংযম, রিপু দমন, নির্জনতা, গভীর ধ্যান-মগ্নতা এবং সংবেদন-শীলতার সঙ্গে তাসাওউফ বা অতীন্দ্রিয়বাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নেই। অবশ্য কখনো কখনো এগুলো মাধ্যম বা প্রক্রিয়া হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। কিন্তু এগুলো কখনো লক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। এমনকি সর্বেশ্বরবাদের চধহঃযবরংস মতো বিশ্বাসের সঙ্গেও এর কোন যোগসূত্র নেই। আমরা যেটাকে সর্বেশ্বরবাদ বলি অর্থাৎ ঈশ্বর সবকিছুতেই আছেন এবং সব কিছুই ঈশ্বর এ জাতীয় বিশ্বাসের সঙ্গেও অতীন্দ্রয়বাদের কোন যোগসূত্র নেই।
জ্ঞান সাধনায় যারা অপরিপক্ক, তারা এমন দাবিও করে থাকেন যে অতীন্দ্রয়বাদ সুংঃরপ সকল প্রকার ইসলামী শরীয়ত ও বিধি বিধানের ঊর্ধ্বে। ইসলাম ধর্মের আরোপিত দায়-দায়িত্বের খুব সামান্য অংশই তাদের উপর বর্তায়। বস্তুত পক্সে এ জাতীয় মতবাদের সঙ্গেও অতীন্দ্রয়বাদের কোন সংযোগ নেই বরং শরীয়তকে নিয়েই তাসাওউফ বিজ্ঞান।
ইসলামী পরিভাষায় ব্যক্তির সর্বোত্তম আচরণ পদ্ধতিকে ইলমে তাসাওউফ বা অতীন্দ্রিয়বাদ বলা যায়। এটা এমন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, প্রতিটি কর্ম ও চিন্তার সাথে অনুভব করে আল্লাহর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি। এরা সারাক্ষণ আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ এবং সান্নিধ্য লাভের আকাক্সক্ষায় মশগুল থাকে। ইসলামী বিধান বিধান মতে একজন মানুষের এমন কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে যেগুলোকে ‘বাহ্যিক’ ইবাদত হিসবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সালাত কায়েম করা, সিয়াম পালন করা, খারাপ এবং মন্দকাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। আবার এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো অভ্যন্তরীণ বলে চিহ্নিত। এর মধ্যে রয়েছে ঈমান, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা, অহংবোধ থেকে মুক্তি থাকা ইত্যাদি। অতীন্দ্রিয়বাদ এক ধরনের প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তি শেষোক্ত দায়িত্বগুলো প্রতিপালনের জন্য চেষ্টা করে। তবু এ কথা সত্য যে, অন্তরকে পরিশালিত করাই বাহ্যিক দায়িত্ব কর্তব্যগুলোর মূল উদ্দেশ্য। এবং এটাই হল শাশ্বত মুক্তির একমাত্র মাধ্যম।
মোট কথা একজন সূফী চিন্তা ও চেতনাকে খুবই উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যান। সাধারণ লোকদের কাছে এটাই প্রতিবাত হয় কারামত হিসাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন সূফী এ ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেন না। বরং তারা এগুলোকে সযত্নে পরিহার বা উপেক্ষা করে থাকেন। বিশেষ সাধনা বলে কারো পক্ষে হয়ত অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু অতীন্দ্রিয়বাদীরা কখনো এমনটি প্রত্যাশা করে না। কারণ অদৃশ্য বিষয় বা গায়েব একমাত্র আল্লাহর ফিতরাতের অন্তর্ভূক্ত। এবং এগুলো প্রকাশের একটি সময়ও আছে। উপযুক্ত সময়ের পূর্বে এই অদৃশ্য বিষয়গুলো প্রকাশিত হলে পরিণতিতে মানুষের জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনে। সে কারণেই সূফীগণের পক্ষে অদৃশ্যকে জানার ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হলেও তিনি কখনো তা প্রয়োগ করেন না। আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য অর্জনের জন্য তারা সব সময় আত্মার পরিশুদ্ধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।
প্রকৃত মু’মিন মুসলমানের বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি সব সময় বাহ্যিক আচার আচরণ পরিশীলিত করেন, দৃঢ় করেন অন্তরের বিশ্বাসকে। সূফীয়ায়ে কিরামের ভাষায় এটাকে বলে শরীর এবং আত্মার শুদ্ধিকরণ-তাযকিয়ায়ে নফ্স। বাহ্যিক আচার-আচরণের জন্য রয়েছে ফিক্হ বা মুসলিম আইন। মানুষের গোটা জীবন জুড়ে এর ব্যাপ্তি। ধর্মীয় বিধি-বিধান, পারস্পরিক সম্পর্ক, শাস্তি, দন্ডবিধি প্রভৃতি বিষয়গুলো এর অন্তর্ভূক্ত। আবার এ বিষয়গুলোর একটি অভ্যন্তরীণ দিকও রয়েছে। এবং ভেতর ও বাহির-এ দুয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে অতীন্দ্রিয়বাদের বিষয়বস্তু। যেমন-সালাতের দুটি দিন রয়েছে। একটি হল সালাত আদায়ের নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান সংক্রান্ত। অপরটি হল সালাতের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। এখানে প্রথমটি ইলমে ফিক্হ এবং দ্বিতীয়টি ইলমে তাসাওউফের আওতাভূক্ত। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের দুটি আয়াতের উল্লেখ করা যেতে পারে ঃ “অবশ্যই সফলকাম হয়েছ মু’মিনগণ, যারা বিনয়-নম্র নিজেদের সালাতে” (২৩ ঃ ১-২)। তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় শৈথিল্যের সঙ্গে, তারা দাঁড়ায় কেবলমাত্র লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে”। (৪ ঃ ১৪২)। এখানে ইবাদতের ভাল ও মন্দ দুটি দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বস্তুতপক্ষে জীবনের প্রতিটি স্তরে ইসরাম মুসলমানদের কাছে যা প্রত্যাশা করে তার প্রতি ইঙ্গিত কার হয়েছে এ আয়াত দুটিতে।
সাধারণ মানুষ এ রকম একটি ইচ্ছা পোষণ করে যে, আল্লাহ তাদের ভালবাসবেন। অথচ তারা নিজেরা আল্লাহকে ভালবাসবে না। তারা আশা করে যে, আল্লাহ্ তাদের কল্যাণ করবেন। অথচ তারা আল্লাহর আনুগত্য করে না। বস্তুতপক্ষে এটা একটা একতরফা ভাবনা। এ ব্যাপারে কুরআনের স্পষ্ট শিক্ষা হল-যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা দৃঢ়তম (২ ঃ ১৬৫)। অপরদিকে সর্বোত্তম ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, “তোমাদের মধ্যে কেউ দীন হতে ফিরে গেলে আল্লাহ মেন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদের তিনি ভালোবাসেন ও যারা তাকে ভালবাসবে” (৫ ঃ ৫৪)।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সঙ্গে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা এবং আরাম-আয়েশের কোন সংযোগ নেই। অবশ্য কখনো কখনো আল্লাপহ তা’আলা ব্যক্তি বিশেষের কৃতজ্ঞতার স্বরূপ পরীক্ষা করার জন্য তাকে বিষয় সম্পদ, আরাম-আয়েশ দিয়ে থাকেন। কখনো আবার এ সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকে তার নাগালের বাইরে। বঞ্চিত অবস্থায় ব্যক্তির আনুগত্যের ও সবর পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ এমনটি করে থাকেন। বস্তুতপক্ষে উভয় অবস্থায়ই আল্লাহর প্রতি মানুষের নিষ্ঠা এবং আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত। এজন্য প্রয়োজন দুটি জিনিসের, প্রথমত আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ এবং অহংবোধের বিলোপ সাধন। দ্বিতীয়ত সর্বক্ষণের জন্য এ রকম একটা অনুভূতির লালন করা যে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এবং তিনি তাকে অবলোকন করেছেন খুবই স্পষ্টভাবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বান্দা যতই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করুক না কেন, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য ও ব্যবধান থাকবে। ধ্যান ও সাধনা বলে বান্দা তার অহংবোধকে বিলুপ্ত করতে পারে। কিন্তু যে তার অস্তিত্বকে কোন ক্রমেই বিলীন করতে পারে না। একজন মু’মিন বান্দা যতই উচ্চতর স্তরে পৌছবে,ততই মনে হবে আল্লাহ যেন ঐ ব্যক্তির জবান দিয়ে কতা বলেছেন, তার হাত দিয়ে কাজ করেছেন। ব্যক্তির অন্তরে যেন আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে।
বান্দা সব সময় স্রষ্টার সান্নিধ্য প্রাপ্তির নিয়ত নিয়ে চলে। কখনো সাধনা বলে পৌছে যায় উচ্চ স্তরে। কিন্তু বান্দা ও আল্লাহ মধ্যে কখনো মিলন ঘটে না। অথবা আল্লাহকে বান্দা বা আল্লাহর বলে ভ্রম হয় না।
বস্তুতপক্ষে আধ্যাত্মিক ধ্যান ধারণা ও সাধনা বলে মানুষ আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করে। এটা এক ধরনের আধ্যাত্মিক ফলস। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলে মি’রাজ। মিরাজের অর্থ সিড়ি বা আরোহণ। এই সিড়ি বেয়ে সবাই সমভাবে উচ্চে আরোহণ অথবা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে না। বরং এ ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে দেখা দেয় বিস্তার তারতম্য। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির সাধনা ও একাগ্রতার উপর।
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারে মানুষের সর্বোচ্চ কল্পনারও একটা সীমা আছে। রাসূলে করীম (সা.) যতখানি আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করেছিলেন, মানুষ ঠিক ততটুকু কল্পনা করতে পারে। এর বাইরে নয়। বলে রাখা আবশ্যক যে, রাসূল করীম (সা.) আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেচেন তাঁর নামকরণ করা হয়েছে মি’রাজ হিসাবে। মি’রাজের সময় রাসূলে করীম (সা.) জাগ্রত এবং সচেতন অবস্থায় জান্নাতে পৌছেন এবং দেখেন (রু’য়া)। এটা ছিল তার জন্য বিশেষ রহমত ও সম্মান। মি’রাজ স্থানিক এবং সময়ের পরিসীমার বাইরে অনুষ্ঠিত হয়। এমতাবস্থায়ও আল্লাহ এবং রাসূল (সা.) এর মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধান থাকে। এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে যে, “তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান থাকল, অথবা তার চেয়ে কম (৫৩ ঃ ৯)। বস্তুতপক্ষে এ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে উভয়ের মধ্যকার নৈকট্য এবং তারতম্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাসূলে করীম (সা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায যে, সাধারণ মুসলমানদেরও মি’রাজ রয়েছে এবং তাহল সালাত। আর এটা নির্ভর করে তার যোগ্যতা ও সাধনার উপর।
আধ্যাত্মিক সাধনার কতকগুলো স্তর রয়েছে। একজন সাধক একটি স্তর অতিক্রম করে পরবর্তী স্তরে গিয়ে পৌছে। রাসূলে করীম (সা.) এর জীবনী থেকেও আমরা দেখতে পাই যে, তিনি শুরু করেন হেরা পর্বতের নির্জনতা থেকে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। এর পর ওহী লাবের প্রত্যাশায় চরম সংযমের পরিচয় দেন। কেবলমাত্র হিজরতের পরই তিনি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় সর্বক্ষণের জন্য ওহী নাযিল হতে থাকে।
আধ্যাত্মিক সাধনায় কে কোন স্তরের তা বলা দুস্কর। এমনটা হওয়া সম্ভব যে, একজন লোককে পোশাক-পরিচ্ছদে দরবেশ বলে মনে হলেও আসলে তার অবস্থা হল ভেড়ার পালের ছদ্মবেশী সিংহের মতো। আবার এমনও হতে পারে যে, একজন রাজা তার পুঞ্জীভূত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি এগুলো থেকে কোন সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন না। কিন্তু দায়দায়িত্ব পালন করে তিনি অদ্ভূত রকমের আত্মসংযমের পরিচয় দেন। সকল প্রকার বিলাস-বৈভব ও আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে তিনি সহজ-সরল জীবন যাপন করেন। তিনিই আসল দরবেশ। ইলমে তাসাওউফের উচ্চতর স্তরে তার অবস্থান।
অহংকার থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বিনয় ও নম্রতা। সাধনা বলে একাকে অর্জন করতে হয়। অপরদিকে গর্ব বা অহংকারকে বিবেচনা করা হয় আল্লাহর সঙ্গে গাদ্দারী হিসাবে এবং এটা মস্তবড় পাপ। ইমাম গাজ্জালী (র.) এর ভাষায় জাঁকজমক ও বাহ্যাড়ম্বর হল নিজের অহংবোধের দাসত্বের নামান্তর এবং সে কারণে এটাকে বলা যায় এক ধরনের হবুদেববাদ।
মানুষের মেজাজ ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য থাকার কারণেই আধ্যাত্মিক সাধনার পন্থা ও প্রক্রিয়ার মধ্যেও বিভিন্নতা রয়েছে। আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য অনেকে পীর-মুুর্শিদের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাদের ধারনা মতে আধ্যাত্মিক সাধনার বিষয়টি চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের মতো। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেই চিকিৎসা শাস্ত অধ্যয়ন করলেও শিক্ষানবিশ হিসাবে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে কিছুকাল অধ্যয়ন করতে হয়। অন্যথায় তাকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না। আধ্যাত্মিক সাধনার ব্যাপারটিও তদ্রƒপ। কারণ নিজের দোষ-ত্র“টিগুলো নিজে দেখার এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা সংশোধন করে নেয়া সম্ভব হয় না। সে কারণেই আমাদের দোষ-ত্র“টিগুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একজন পীর-মুর্শিদ বা শিক্ষকের। এ সমস্ত দোষ-ত্র“টিগুলো থেকে উত্তরণের পথও তিনি দেখিয়ে দেন।
বস্তুতপক্ষে প্রতিনিয়ত ব্যক্তির বিকাশ ঘটছে এবং বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে গ্রহণ করছে একটি স্থায়ী পথ পরিক্রমা। এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার পীর-মুর্শিদ অপ্রয়োজনীয় কতকগুলো প্রচেষ্টাকে পরিহার করতে সাহায্য করেন। কেউ যদি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে না চায় এবং প্রত্যেক নবজাতকই যদি সমস্ত কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করতে চায়, নির্ভর করতে চায় সম্পূর্ণরূপ নিজের উপর, তাহলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে না। কারন সভ্যতা ও সংস্কৃতি হল আমাদের পূর্ব-পুরুষগণের জ্ঞান ও কর্মের ফসল।
শিক্ষকের বিচার-বিবেচনার প্রতি একজন ছাত্রের অগাধ শ্রদ্ধা ও আস্থা থাকে। কিন্তু তার সহকর্মী ও সমপর্যায়ের লোকদের উপর তা থাকে না। যে কোন বিষয় তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভের পর প্রয়োগিক বিষয়ে জানার জন্য ছাত্রকে কিছুকাল শিক্ষানবীশ হিসাবে থাকতে হয়। জড় বিজ্ঞানের জন্য এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে। ধরা বুকে এমন অনেক বিষয় আছে যা কেবলমাত্র অধ্যয়ন বা শ্রবণ করে শেখা যায় না। এজন্য প্রয়োজন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থেকে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ। এ ধরনের প্রশিক্ষণ অবধারিত বলে বিবেচিত না হলেও অবশ্যই জরুরী এবং সব সময়ের জন্য একথা সত্য। উপরুন্তু কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জন করাটাই পর্যাপ্ত নয়। এটাকে আত্মস্থ করতে হয়, নিয়ে আসতে হয় নিজের উপলব্ধিতে। তাহলেই এটা পরিণত হয় মানুষের স্বভাবে।
সূফীয়ায়ে কিরাম আচার-আচরণের চারটি মৌলিক নীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে স্বল্প নিদ্রা, অল্প আহার, কম কথা এবং মানুষের সঙ্গে কম মেলামেশা। এখানে স্বল্প বা কম বলতে উপরোক্ত বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা বুঝায়নি। কারণ এগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিহার করাটা কেবলমাত্র অনাকাক্সিক্ষতই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের সাধ্যেরও বাইলে। যেমন আহার ও নিদ্রাকে কখনো পুরোপুরি পরিহার করা যায় না। আসলে আহার, নিদ্রা, কথাবার্তা ও মেলা মেশায় সব সময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, মানুষকে খেতে হবে বাচার জন্য, কিন্তু খাওয়ার জন্য বেচে থাকবে না। আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশকে প্রতিপালনের জন্য প্রয়োজন শক্তির। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে যদি খাবার গ্রহণ করে তখন সেটা বিবেচিত হবে ইবাদ হিসাবে। অপরদিকে খাদ্য পরিহার করার কারণে যদি সে দুর্বল হয়ে পড়ে ও অপুষ্টিতে ভোগে এবং সে কারণে তার আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষমতা হ্রাস পায় তাহলে সেটা দোষের হবে। সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন নিদ্রার এবং সে কারণেই ঘুমকে মানুষের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অলসতা করলে অবস্থা দাঁড়াবে টিক এর উল্টো। আলস্যে মানুষ যেন তেন ভাবে শুয়ে বসে সময় কাটায়। এটা আধ্যাত্মিক সাধনাকে বাধাগ্রস্ত করে। স্বল্প নিদ্রার অর্থ এই নয় যে ঘুমকে পরিহার করে জাগতিক কাজকর্মের মধ্যে ডুবে থাকবে। বরং নিদ্রার পরিমাণ হ্রাস পেলে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী এবং সৎকাজ করার জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে।
কথা কম বলার অর্থ হল অপ্রয়োজনীয় এবং নিরর্থক আলাপচারিতা থেকে বিরত থাকা। সম্ভব হলে সকল প্রকার খারাপ কথাবার্তা পরিহার করা। প্রায়ই দেখা যায় যে, আমরা অপরকে খুব ভালো ভালো পরামর্শ দেই, অথচ আমরাই আবার এগুলো প্রতিপালনের কথা ভুলে যাই। বস্তুতপক্ষে এটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষের সঙ্গে কম মেলামেশার অর্থ হল অনাবশ্যক যোগাযোগ বা অহেতুক হাসি-তামাশার থেকে বিরত থাকা। যে মেলামেশার মাধ্যমে অপরের উপকার করা যায়, ব্যস্ত থাকা যায় এমন কোন কাজের মধ্যে যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব, তেমন মেলামেশাই মানুষের জন্য কাক্সিক্ষত।
আমাদের এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ব্যক্তির বিকাশের স্তর অনুসারে তার চাহিদা সঙ্গে অন্যের চাহিদার তারতম্য ঘটে। সে কারণেই একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের জন্য যে উপদেশ প্রযোজ্য, একজন শিক্ষানবিশের বেলায় তা খাটে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, জাগতিক মেলামেশা অনেক সময় আমাদের মধ্যে প্রলোভনের উদ্রেক করে, মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটায়, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোকে ঠেলে দেয় বিস্মৃতির অন্তরালে।
উপরে উল্লিখিত চার ধরনের আচরনবিধির সঙ্গে আরেকটি বিষয় সংযোগ করা যেতে পারে। সেটি হল স্বল্প ব্যয়। এর অর্থ হল কোন জৌলুশ বা তুচ্ছ কারণে অথবা আত্মতৃপ্তির জন্য অর্থ ব্যয় থেকে বিরত থাকা। তা এমন কোন কাজে ব্যয় করা উচিত যা সকলের জন্য পসন্দীয় এবং কল্যাণকর হয়।
উল্লিখিত এ পাঁচটি আচরণবিধিকে গ্রহণ করা যেতে পারে ইসলামের আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক জীবনের ৫টি মৌল নীতি হিসাবে।
প্রতিটি মুসলমানকে সর্বক্ষণের জন্য আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। এ স্মরণ হতে হবে অন্তর থেকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় একাগ্রচিত্তে আল্লাহকে স্মরণ করার কাজটা বেশ কঠিন। এজন্য আধ্যাত্মিক সচেতনতাকে জোরদার করতে হবে। চিন্তাকে নিবদ্ধ করতে হয় আল্লাহর প্রতি। এ কাজ দুটি করার জন্য তাকে কতকগুলো শারীরিক নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে হয়। কুরআন মজীদে উল্লেখ আছে যে,হে মু’মিনগণ। তোমরা অধিক পরিমানে আল্লাহর যিকর কর, এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা কর। (৩৩ ঃ৪১-৪২)।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে, হে আমাদের রব তুমি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করোনি, তুমি পবিত্র। তুমি আমাদিগকে অগ্নি-শাস্তি হতে রক্ষা কর (৩ ঃ ১৯১)।
এমন কিছু ইবাদ পদ্ধতি রয়েছে যেখানে কতকগুলো সবক বার বার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। আবার এমন কিছু ইবাদত-বন্দেগী আছে যেগুলো একজন মানুষ অভ্যাসগতভাবেই নিয়মিত আদায় করে থাকে। কখনো এগুলো সে আদায় করে উচ্চস্বরে, কখনো আবার নিম্নস্বরে। তবে ইবাদত-বন্দেগীর ধরণ যাই হোক না কেন, এগুলো অবশ্যই এক আল্লাহ জাল্লাশানুহুর পবিত্র গুণরাজির স্মরণে হতে হবে। কখনো এর ব্যতিক্রম হতে পারবে না। অথবা কখনো তা কোন সৃষ্টির প্রতি নিবেদন করা যাবে না। এমনকি ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কথা আমাদের স্মরণে আসলেও মহান আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা থাকবে মুখ্য। আমাদের যা কিছু চাওয়ার তা একমাত্র আল্লাহর নিকট হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উসীলা করে আল্লাহর নিকট মোনাজাত করা যেতে পারে। সে কারণেই আমরা এভাবে মোনাজাত করে থাকি যে-হে আল্লাহ তুমি রাসূলে করীম (সা.) এর প্রতি সদয় হও এবং তাঁকে হিফাজত কর।” অথবা “হে আল্লাহ। মুহাম্মদ (স:) কে দান কর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান ও সুমহান মর্যাদা যার প্রতিশ্র“তি তুমি তাঁকে দিয়েছ, এবং আমাদের পক্ষে তাঁর উসীলাকে তুমি কবুল কর।”
চিন্তায় স্থিরতা আনার জন সূফীয়ায়ে কিরাম বিশেস কতকগুলো পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। যেমন-তারা কখনো কখনো নির্জনে নিভৃতে চলে যান। কখনো আবার চোখ বুজে ক্ষণিকের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ রাখেন। এবং আল্লাহর যিক্র-এ মগ্ন থেকে হৃদয়ের স্পন্দনের প্রতি দৃঢ়ভাবে মনোনিবেশ করেন। তাঁরা আরো বলে থাকেন যে, আল্লাহকে স্মরণ করার তিনটি স্তর রয়েছে (ক) কেবলমাত্র তাঁর নামের যিকর করা। (খ) বিভিন্ন নামে বা সীফাতের মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বের যিকর করা। (গ) কোন সীফাত বা নামের উল্লেখ না করে একান্তভাবে তাঁর অস্তিত্বকে স্মরণ করা। রাসূলে করীম (সা.) নিজেও ইবাদ-বন্দেগীর এ সমস্ত ব্যবস্থাদির ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) এর সূতার তৈরি একটি তসবীহ ছিল। এতে ছিল ২০০০ গিট। প্রতিটি গিট ব্যবহৃত হত এক একটি পুতি হিসাবে। প্রতিনিদ রাতে তিনি একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় বারবার এই তসবীহ পাঠ করতেন। অন্যান্য আচারসমূহের মধ্যে কেউ হয়তো বলবেন কৃচ্ছতা সাধনের কথা, নিজের কামনা-বাসনা দমনের কথা, বিশেষ করে মৃত্যু ও শেষ বিচার সম্বন্ধে চিন্তায় মনোনিবেশ করতে হবে। ইসলামে এগুলোই লক্ষ্য নয়, এগুলো হচ্ছে খুদীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়মাত্র। (অসমাপ্ত)