আমাদের অহংকার একুশে ফেব্রুয়ারি

107

শেখ একেএম জাকারিয়া

অমর একুশে ফেব্র“য়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য ঢাকা নগরীর প্রধান সড়কে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এদেশের বীর সন্তানরা। তাঁদের স্বার্থহীন জীবনদানের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে অতি মধুর মায়ের ভাষা, বাংলা। যা আমাদের প্রাণের ভাষা, গানের ভাষা, আবেগের ভাষা। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সকল মহান শহীদদের। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে উদযাপিত হবে এ দিবসটি। একুশ আমাদের জাতীয় অনুভূতি, একুশ আমাদের উদ্দীপনা, একুশ আমাদের অহংকার। কবির ভাষায়, ‘একুশ আমার হাওর জলে, সাদা বুনোহাঁস/একুশ আমার কিশোরবেলার, বায়ান্নটা তাস।/একুশ আমার বিরনি চালের দারুণ মজার ক্ষীর/ একুশ আমার স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার নীড়।/ একুশ আমার খেলার সাথী, ছোট্টবেলার সই/একুশ আমার আমার মায়ের দেওয়া,অআ, কখ বই।
সকলেই বিদিত ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা অত্যন্ত শোকাবহ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে আকস্মিক ঘটনা ঘটেছিল তা প্রতিটি বাঙালির বুকের অভ্যন্তর ভাগকে রক্তাক্ত করে। ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য ধর্মভিত্তিক দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের সাম্প্রদায়িক মতবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তান অধিরাজ্যের দু’টি অংশ ছিল: পূর্ব বাংলা (যা ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান নামে পুনর্নামাঙ্কিত হয়) ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। তাদের ভাষা ছিল বাংলা। আর পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে বেশকিছু মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান ছিল।
অতীব দু:খের বিষয়, পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশ বাদী, ক্ষমতালিপ্সু, গর্বোদ্ধত শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকেই বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম তুচ্ছতাচ্ছিল্য পোষণ করা শুরু করে। সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীন শাসকরা পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর উৎপীড়নের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। শুরুতেই তারা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়, কীভাবে পুরো ঢাকা শহর তথা এদেশের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া যায়। এ অংশের মানুষকে দাসত্ব-শৃঙ্খল পরানোর জন্য তারা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালিদের ঘাড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার নীলনকশা তৈরি করে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার এক জনসমাবেশে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এদেশের ছাত্র সমাজ সে জনসমাবেশে নতুন ধ্বনি তুলে তার প্রগলভতা পূর্ণ ঘোষণার যথাবিহিত জবাব দেয়। প্রতিবাদের ভাষা এবং এর ব্যাপ্তি ক্রমানুসারে বাড়তে থাকে।
পাকিস্তান সরকার সকল প্রতিবাদকে অমানুষিক শক্তি দ্বারা দমনের চেষ্টা চালায়। তাদের পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ছাত্রসমাজসহ দেশের অধিকাংশ তরুণ। এদেশের সূর্য সন্তানরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য অত্যন্ত দৃঢ় শপথ গ্রহণ করে। ঢাকা শহর তথা আমাদের দেশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং মিছিল হবে তা আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এমন সংবাদ পেয়েই পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্যে পাকিস্তান সরকার ১১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা আইন জারির মাধ্যমে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অপরদিকে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা গোপন বৈঠক করে এবং সিদ্ধান্ত হয় যেমন করেই হোক তারা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করবেই। সে সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ছাত্ররা রাজপথে মিছিল বের করে। সেদিন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কন্ঠে ধ্বনিত হয় নিজ অধিকার আদায়ের দাবি। প্রাদেশিক অধিবেশন শুরু হয়েছিল সে সময়। ভাষার দাবিতে অত্যন্ত মুখর মিছিলটি এগিয়ে যায় প্রাদেশিক ভবনের দিকে। মিছিল নিয়ে ছাত্ররা যখনই ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসে তখনই ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে ও মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার লক্ষ্যে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের ফলে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিউলসহ আরও অনেকেই শহীদ হন। আহত হন অনেক মানুষ। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। দুঃখজনক এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় প্রচণ্ড ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শহীদরা লিখে যান এক অনুপম ইতিহাস। তাদের এ মহান আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। বাঙালির স্মৃতিতে দীপ্তিমান হয়ে থাকে সেই দিন, সেই রক্তমাখা রাজপথ। আনন্দের বিষয়, বায়ন্ন’র ভাষা আন্দোলনের বহু বছর পর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্য এ সংগ্রাম বিশ্বের বুকে মর্যাদার স্থান পায়। গত ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।