গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ মুজিববর্ষে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেবে সরকার

26
সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতীয় নাট্যশালার উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মুজিববর্ষে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আরও ২৩ উপজেলার শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের উদ্বোধনীতে বলেন, দেশের একটি ঘরও আর অন্ধকারে থাকবে না। ইনশাআল্লাহ এই মুজিববর্ষে আমরা বাংলাদেশের সব ঘরে আলো জ্বালব। প্রধানমন্ত্রী এ সময় সাত উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাজশাহীতে শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেটর এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। গণভবনে আয়োজিত অপর এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মাসব্যাপী নাট্যোৎসবের উদ্বোধন করেন।
সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের শুরুতে বলেছিল ২০২১ সালের মধ্যে সব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে। তবে এই লক্ষ্য এক বছর এগিয়ে আনা হয়েছে এখন দেশের ৪১০ উপজেলায় ১০০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছে। বাকি উপজেলাগুলোতেও দ্রুত এগিয়ে চলেছে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ। এখন দেশের ৯৬ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সেবার আওতায় এসেছে। গত এক দশকে দেশের বিদ্যুৎ সেবা সম্প্রসারণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের একটি ঘরও আর অন্ধকারে থাকবে না। ইনশাআল্লাহ এই মুজিববর্ষে আমরা বাংলাদেশের সব ঘরে আলো জ্বালব। এ লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, দ্বিতীয়বার যখন সরকার গঠন করি তখন এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট থেকে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটে উৎপাদন বৃদ্ধি করে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর দেখি উৎপাদন বৃদ্ধি করেনি। বরং বিদ্যুতের উৎপাদন কমেছে। সেই জায়গা থেকে আমরা যাত্রা শুরু করে আজ ২৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে। ক্যাপটিভ জেনারেশন ধরলে বোধ হয় আরও বাড়বে। তিনি বলেন, দেশের এখন ৯৬ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী সাত জেলা ও ২৩ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন এবং ফেনী ১১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতার সাত জেলা হলোÑ ঢাকা, ফেনী, গোপালগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাট এবং মেহেরপুর। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ২৩ উপজেলা হলোÑ বাগেরহাট সদর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসিরনগর, মেহেরপুরের আলমডাঙ্গা, কুমিল্লার দেবীদ্বার এবং মনোহরগঞ্জ, দিনাজপুরের খানসামা, জামালপুরের মাদারগঞ্জ, যশোরের সদর ও মণিরামপুর, খুলনার তেরখাদা, কুষ্টিয়ার মিরপুর, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও জুড়ী, নওগাঁর বাদলগাছী ও পতœীতলা, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, নীলফামারীর জলঢাকা, শেরপুরের নকলা ও ঝিনাইগাতী, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল এবং সুনামগঞ্জের ছাতক।
প্রযুক্তি শিক্ষা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। বর্তমান যুগটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে এটা কখনও হতে পারে না। নতুন প্রজন্মকে এমনভাবে শিক্ষিত করতে চাই যেন প্রতিযোগিতাময় এ বিশ্বের সঙ্গে তারা তাল মিলিয়ে চলতে পারে। সে জন্য প্রযুক্তি শিক্ষাটা একান্ত প্রয়োজন।
তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টরের সম্প্রসারণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, প্রযুক্তি নির্ভর একটা জাতি গোষ্ঠী গড়ে তুলতে চাই। নতুন প্রজন্ম যেন আরও আগ্রহী হয়, সেদিকে নজর রেখে আমরা কম্পিউটার শিক্ষা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুমসহ বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছি। অনলাইনে ঘরে অর্থ উপার্জনের সুযোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে অনলাইনে আউটসোর্সিং করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। একেবারে গ্রামে বসেও অর্থ উপার্জন করতে পারে। সেই সুযোগটা আমরা সৃষ্টি করেছি, এ সুযোগ আরও সম্প্রসারণ করতে সরকার কাজ করছে।
‘শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেটর এ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’- এর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে ট্রেনিং নেবে, এর ফলে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, তারা নিজেরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, উদ্যোক্তা হতে হবে। চাকরি না করে উল্টো চাকরি দেব- এই চিন্তাটা থাকতে হবে।
অবহেলিত রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজশাহীর লোক ভোট দিচ্ছে অন্য জায়গায় কিন্তু রাজশাহীর লোক সুবিধা পাচ্ছে যখন আমরা ক্ষমতায় আসি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই। এ অঞ্চলে যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে আদর্শ নিয়ে, যে চিন্তা নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই চিন্তা-চেতনা থেকে বাংলাদেশ সরে এসেছিল। কারণ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী-ষড়যন্ত্রকারীরা পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসেছিল। কাজেই বাংলাদেশকে আর তারা এগুতে দেয়নি। তিনি বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারে আসে। সরকারে আসার পর থেকে আমাদের প্রচেষ্টা ছিল, যে চিন্তা-চেতনা নিয়ে জাতির পিতা স্বাধীনতা এনেছিলেন তা বাস্তবায়ন করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার যে স্বপ্ন ছিল, তা আমরা অর্জন করব। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছি। প্রথমবার ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর আমরা ক্ষমতায় ছিলাম। এরপরে আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯-এ সরকার গঠন করি। সরকার পরিচালনার সুযোগ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশবাসী এবং ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম যারা তাদের এমনভাবে শিক্ষিত করতে চাই, যেন প্রতিযোগিতাময় এই বিশ্বের সঙ্গে তারা তাল মিলিয়ে চলতে পারে। সেই জন্য প্রযুক্তি শিক্ষাটা একান্তভাবে দরকার। তাই আইসিটি নির্ভর একটা জাতিগোষ্ঠী গড়ে তোলার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা যখন আসি, তখন দেখেছি, একটা মোবাইল ফোনের দাম ছিল এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। ফোন করলে প্রতি মিনিটে ছিল দশ টাকা, ধরলেও দশ টাকা। ধরলেও দশ, করলেও দশ; এই ছিল অবস্থা। এখন তো প্রতিযোগিতার যুগে খুব অল্পতেই ব্যবহার করা যায়। আর আমরা বাঙালীরা এমনি একটু কথা বেশি বলতে পছন্দ করি; বোধ হয় বিশ্বের সব থেকে বেশি ফোনের ব্যবহার বাংলাদেশেই হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কত সময় ব্যয় ব্যবহার হয়, সেটা যদি হিসাব করি, সেটা দেখব আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৩ কোটি সিম ব্যবহার হয়ে থাকে। এখানে ছোট শিশুরা আছে, বা বয়োবৃদ্ধরা আছে, হিসাব করলে দেখা যায় যে, সকলেই দুইটা-তিনটা করে ফোন ব্যবহার করছে এবং একটু সুযোগ পেলেই আমরা কথা বলছি। কথা বলার সময় আমাদের খেয়ালও থাকে না, কতক্ষণ কথা বলছি। আমরা অনেক ক্ষেত্রে একেবারে মোবাইলে যে টাকাটা লোড করলাম, সে টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কথা আমরা বলেই যাই।
উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী রাজশাহী, বাগেরহাট, সুনামগঞ্জ, মেহেরপুর, গোপালগঞ্জ জেলার সুবিধাভোগী মানুষের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময় করেন। এ সময় গণভবন প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এম তাজুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম, সংসদ সদস্য একেএম রহমতুল্লাহ, শহীদুজ্জামান সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব এন এম জিযাউল আলম এবং বিদ্যুত বিভাগের সচিব সুলতান আহমেদ নিজ নিজ বিভাগের উন্নয়নের তথ্যচিত্র অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন শেষে মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান। এরপর প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংযুক্ত হয়ে উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
যুবকদের সুপথে আনতে সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ : বিপথগামী শিশু, কিশোর, যুবকদের সুপথে আনতে খেলাধূলা ও সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বর্তমান যুগে অনেক সময় দেখা যায়, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ একটা পরিবার, একটা সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুব সমাজ তাদের যদি আমরা সঠিক পথে আসতে চাই, তাহলে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা এসব দিকে যত বেশি তাদের আমরা সম্পৃক্ত করতে পারবÑ ততই আমরা তাদের সুপথে আনতে পারব।
বুধবার দুপুরে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সারাদেশে মাসব্যাপী নাট্যোৎসবের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর বিভাগে শিল্পকলা একাডেমিতে সংযুক্ত হয়ে মতবিনিময় করেন। তার আগে গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে কয়েকটি জেলায় যুক্ত হয়ে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপভোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি রাজনীতি করি বক্তৃতা দেই। বক্তৃতা মানুষের কাছে পৌঁছে এটা ঠিক। কিন্তু একটা গানের মধ্য দিয়ে বা কবিতার মধ্য দিয়ে বা একটা নাটকের মধ্য দিয়ে অনেক না বলা কথা বলে দেয়া যায় এবং মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। মানুষের অনেক দাবি দাওয়া তুলে ধরা যায় এই নাটকের মধ্য দিয়ে, গান এবং কবিতার মধ্য দিয়ে।