আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি সৈয়দ শামসুল হক ‘একুশের কবিতায়’ সভ্যতার মনিবন্ধে সময়ের ঘড়ি/ শিশু জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায় বলে গেল সেই কথা/ সেই কথা বলে গেল অনর্গল-’ কবিতায় গানে গল্প উপন্যাসে মায়ের ভাষা বাংলাকে নিয়ে এভাবেই আবেগ প্রকাশ হয়ে আসছে ’৫২ থেকে আজ পর্যন্ত। বাংলার মানুষের কাছে পাকিরা মায়ের ভাষাকে রক্তে মাখিয়ে দিয়েছে। সেই মায়ের ভাষায় শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি চলছেই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন মায়ের ভাষা যে রক্তে রঞ্জিত সেই ইতিহাস নদীর মতোই বহমান থাকবে।
মাতৃভাষা আন্দোলনের শুরুটা ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ। ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ও সেখানে তিনি ভাষণ দেন। তার ভাষণে তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী। কিন্তু তিনি দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা-অন্য কোন ভাষা নয়।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনই ক্ষমা করা হবে না। জিন্নাহ এ বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা- এ ধরনের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও জিন্নাহ একই ধরনের বক্তব্য রাখেন। তিনি উল্লেখ করেন এ আন্দোলন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বহিপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। যখন তিনি উর্দুর বিষয়ে তার অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে।
একইদিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। কিন্তু জিন্নাহ্ ও খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখ্যান করেন। অনেক তর্ক-বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জিন্নাহ্র কাছে স্মারকলিপি পেশ করে। ২৮ মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে দেয়া ভাষণে তার পূর্বেকার অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন। জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে তমদ্দুন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহার কাছে হস্তান্তর করেন। পরবর্তীতে তমদ্দুন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে।
বদরুদ্দীন উমর ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাত দেন। ওই সাক্ষাতটি ছিল চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের বাসভবনে। সেদিন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খান, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, আলি আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম।