জাহান্নামের বর্ণনা ও জাহান্নামীদের শাস্তি কি হবে সকলে জেনে নিন!

149

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী

(পূর্ব প্রকাশের পর)
জাহান্নামের জ্বালানী
মহান আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের জ্বালানী হিসাবে পাথর এবং পাপিষ্ঠ কাফিরদেরকে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মমহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফিরিশতাগণ, যারা অমান্য করেনা তা, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই করে’ {সূরা আত-তাহরীম: ৬}।
অত্র আয়াতে মানুষ বলতে কাফির-মুশরিকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। আর পাথর বলতে কোন প্রকারের পাথর যা আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করবেন তা আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন। তবে বলা হয়ে থাকে, ইহা ঐ সমস্ত মুর্তি, কাফির-মুশরিকরা যাদের ইবাদত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর সেগুলি তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে উহাতে প্রবেশ করবে’ {সূরা আম্বিয়া: ৯৮}*১৮* কিছু সংখ্যক সালাফে ছালেহীন বলেছেন, ইহা গন্ধক পাথর যা আগুনকে প্রজ্জ্বলিত করে।*১৯*
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এটা গন্ধক পাথর যা আগুনকে প্রজ্জ্বলিত করে, যা আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমীন সৃষ্টির সময় সৃষ্টি করে কাফিরদের জন্য নির্ধারণ করেছেন।*২০*
ইবনে রজব (রহ.) বলেন, অধিকাংশ মুফাসসিরগণ পাথর বলতে গন্ধক পাথরকে বুঝিয়েছেন যা আগুনকে প্রজ্জ্বলিত করে এবং বলা হয়ে থাকে এই আগুনে পাঁচ প্রকার শাস্তি বিদ্যমান। ১- দ্রুত আগুন প্রজ্জ্বলিতকরণ। ২- অতি দুর্গন্ধময়। ৩- অতিরিক্ত ধোঁয়া নিসৃতকরণ ৪- কঠিনভাবে শরীরের সাথে আগুনের সংযুক্তকরণ। ৫- তাপের প্রখরতা।*২১*
মানুষ আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যে সকল ব্যক্তি বা বস্তুকে মা‘বুদ হিসাবে গ্রহণ করেছে, আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের জ্বালানী হিসাবে মানুষ এবং পাথরের সাথে সে সকল মা‘বুদদেরকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর সেগুলিতো জাহান্নামের ইন্ধন, তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে। যদি তারা ইলাহ হতো তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করত না, তাদের সকলেই তাতে (জাহান্নামে) স্থায়ী হবে’ {সূরা আম্বিয়া: ৯৮-৯৯}।
জাহান্নামের আগুনের প্রখরতা এবং ধোঁয়ার আধিক্য
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর বাম দিকের দল, কত হতভাগ্য বাম দিকের দল! তারা থাকবে তীব্র গরম হাওয়া এবং প্রচন্ড উত্তপ্ত পানিতে, আর প্রচন্ড কালো ধোঁয়ার ছাঁয়ায়, যা শীতলও নয়, সুখকরও নয়’ {সূরা ওয়াকি‘আহ: ৪১-৪৪}।
অত্র আয়াত সমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিনের প্রচন্ড তাপ থেকে মানুষকে ঠান্ডা করবেন তিনটি বস্তু দ্বারা, তা হল: ১- পানি ২- বাতাস এবং ৩- ছাঁয়া, যার সামান্যটুকুও জাহান্নামীদেরকে দেয়া হবে না।
অতএব, জাহান্নামের বাতাস যা তার অধিবাসীদেরকে দেয়া হবে, তা প্রচন্ড গরম বাতাস। আর পানি যা পান করতে দেয়া হবে, তা প্রচন্ড গরম পানি। আর ছাঁয়া যা তাদেরকে আচ্ছাদন করে রাখবে, তা জাহান্নামের আগুন নিসৃত ধোঁয়ার ছাঁয়া। এগুলো জাহান্নামীদের কোন উপকারে আসবে না, বরং এগুলো তাদের অধিক শাস্তির কারণ হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘চল তিন শাখাবিশিষ্ট ছাঁয়ার দিকে, যে ছাঁয়া শীতল নহে এবং যা রক্ষা করে না অগ্নিশিখা হতে, উহা উৎক্ষেপ করবে বৃহৎ স্ফুলিংগ অট্টালিকাতুল্য, উহা পীতবর্ণ উষ্ট্রশ্রেণী সদৃশ’ {সূরা মুরসালাত: ৩০-৩৩}।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুন নিসৃত ধোঁয়ার তিনটি প্রকার উল্লেখ করেছেন, ১- ছাঁয়া সদৃশ ধোঁয়া যা শীতল করে না। ২- এই ধোঁয়া জ্বলন্ত অগ্নিশিখা থেকে রক্ষা করতে পারে না। ৩- এই ধোঁয়া মোটা কালো উষ্ট্রি সদৃশ।
আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুনের প্রখরতা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি তাকে নিক্ষেপ করব সাকার-এ, তুমি কি জান সাকার কি? উহা তাদেরকে জীবিতাবস্থায় রাখবে না এবং মৃত অবস্থায়ও ছেড়ে দেবে না, ইহা তো গাত্রচর্ম দগ্ধ করবে’ {সূরা মুদ্দাছছির: ২৬-২৯}।
অতএব, জাহান্নামের আগুন জাহান্নামীদের সবকিছু খেয়ে ধ্বংস করে ফেলবে। তারা সেখানে না পারবে মরতে, না পারবে বাঁচতে। জাহান্নামীদের চামড়া-মাংস পুড়িয়ে হাড্ডি পর্যন্ত পৌঁছে যাবে এবং পেটের ভেতরের সবকিছু বের করে ফেলবে।
জাহান্নামের আগুনের প্রখরতা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, তোমাদের আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ মাত্র। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! জাহান্নামীদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য দুনিয়ার আগুনই তো যথেষ্ট ছিল। তিনি বললেন, দুনিয়ার আগুনের উপর জাহান্নামের আগুনের তাপ আরো উনসত্তর গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, প্রত্যেক অংশে তার সমপরিমাণ উত্তাপ রয়েছে।*২২*
আর জাহান্নামের আগুনের তাপ কখনো প্রশমিত হবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অতঃপর তোমরা আস্বাদ গ্রহণ কর, আমি তো তোমাদের শাস্তিই শুধু বৃদ্ধি করব’ {সূরা নাবা: ৩০}
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘যখনই উহা (জাহান্নামের আগুন) স্তিমিত হবে আমি তখনই তাদের জন্য অগ্নিশিখা বৃদ্ধি করে দেব’ {সূরা বানী ইসরাঈল: ৯৭}।
যার কারণে জাহান্নামীরা কখনো সামান্যটুকু বিশ্রামের অবকাশ পাবে না এবং তাদের থেকে শাস্তির কিছুই কমানো হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সুতরাং তাদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং তারা কোন সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ {সূরা বাক্বারহা: ৮৬}।
ইবনে উমার (রা.)-এর স্বপ্নে জাহান্নাম দর্শন
ইবনু উমার (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বেশ কয়েকজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে স্বপ্ন দেখতেন। অতঃপর তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তা বর্ণনা করতেন। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) এগুলোর ব্যাখ্যা দিতেন যা আল্লাহ ইচ্ছা করতেন। আমি তখন অল্প বয়সের যুবক। আর বিয়ের পূর্বে মসজিদই ছিল আমার ঘর। আমি মনে মনে নিজেকে সম্বোধন করে বললাম, যদি তোমার মধ্যে কোন কল্যাণ থাকত তাহলে তুমি তাঁদের মত স্বপ্ন দেখতে। আমি এক রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বললাম, হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, আমার মধ্যে কোন কল্যাণ আছে তাহলে আমাকে কোন একটি স্বপ্ন দেখান। আমি ঐ অবস্থায়ই (ঘুমিয়ে) থাকলাম। দেখলাম আমার কাছে দু’জন ফেরেশতা এসেছেন। তাঁদের প্রত্যেকের হাতেই লোহার একটি করে হাতুড়ি। তারা আমাকে নিয়ে (জাহান্নামের দিকে) এগোচ্ছে। আর আমি তাঁদের দু’জনের মাঝে থেকে আল্লাহর কাছে দু’আ করছি, হে আল্লাহ! আমি জাহান্নাম থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এরপর আমাকে দেখানো হল যে, একজন ফেরেশতা আমার কাছে এসেছেন। তাঁর হাতে লোহার একটি হাতুড়ি। সে আমাকে বলল, তোমার অবশ্যই কোন ভয় নেই। তুমি খুবই ভাল লোক, যদি অধিক করে ছালাত আদায় করতে! তাঁরা আমাকে নিয়ে চলল, অবশেষে তাঁরা আমাকে জাহান্নামের কিনারায় দাঁড় কারালেন, (যা দেখতে) কূপের মত গোল আকৃতির। আর কূপের মত এরও রয়েছে অনেক শিং। আর দু’শিং-এর মাঝখানে একজন ফেরেশতা, যার হাতে লোহার একটি হাতুড়ি। আর আমি এতে কিছু লোককে (জাহান্নামে) শিকল পরিহিত দেখলাম। তাদের মাথা ছিল নিচের দিকে। কুরাইশের এক ব্যক্তিকে সেখানে আমি চিনে ফেললাম। অতঃপর তারা আমাকে ডান দিকে নিয়ে ফিরল। এ ঘটনা (স্বপ্ন) আমি হাফছাহ (রা.)-এর নিকট বর্ণনা করলাম। আর হাফছাহ (রা.) তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট বর্ণনা করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আব্দুল্লাহ তো নেককার লোক। নাফে’ (রহ.) বলেন, এরপর থেকে তিনি সর্বদা অধিক করে (নফল) ছালাত আদায় করতেন।*২৩*
নিশ্চয়ই ইহা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে’ {সূরা হুমাযাহ্: ১-৯}।
জাহান্নামের প্রহরী
মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন নির্মমহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণকে জাহান্নামের প্রহরী নিযুক্ত করেছেন যারা আল্লাহর আদেশ পালনে সদা প্রস্তুত থাকে, কখনোই তা অমান্য করে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘হে মু’মিনগণ তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মমহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না আল্লাহ তাঁদেরকে যা আদেশ করেন তা পালনে। আর তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই পালন করে’ {সূরা আত-তাহরীম: ৬}। (অসমাপ্ত)