কে জিতল? ইরান না আমেরিকা?

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কাসেম সোলেইমানি হত্যা এবং তার বদলায় ইরাকে মার্কিন দুটো ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দীর্ঘস্থায়ী এবং বিপজ্জনক এক সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে। প্রথম দফার সংঘাতে কে জিতলো এবং কে হারলো – সেই কাটা-ছেঁড়া হচ্ছে। তবে ইরান বা আমেরিকার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তার জেরে দ্রুত বদলে যেতে পারে প্রথম দফার হার-জিতের এসব সমীকরণ। কিন্তু এই পর্যায়ে জিত হলো কার? হারলো কে?
ইরান
যদিও ইরান তাদের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন জেনারেলকে হারিয়েছে, তারপরও তার মৃত্যু থেকে স্বল্প মেয়াদে তারা লাভবান হতে পারে।
নভেম্বরে ইরানে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিক্ষোভ যেভাবে নৃশংসভাবে সরকার দমন করেছে মি. সোলেইমানির জানাজায় নজিরবিহীন জনসমাগমে তা চাপা পড়ে গেছে।
ইরানি জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ দিয়ে ইরান আরেকবার বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে দেশের ভেতর রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও, জাতীয় সঙ্কটের সময় তার ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
২০১৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একর পর এক নিষেধাজ্ঞার চাপে ইরানের অর্থনীতির এখন বেহাল দশা। গত বছর দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা চরমে ওঠে যখন ইরান একটি মার্কিন ড্রোন বিমান গুলি করে নামায়, এবং দুটো তেলে ট্যাংকার আটক করে। এরপর গত বছর সেপ্টেম্বরে সৌদি একটি তেলক্ষেত্রের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্যও ইরানকে দায়ী করেছে আমেরিকা, যদিও ইরান সবসময়ই তা অস্বীকার করেছে।
কাসেম সোলেইমানির হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে ইরান বুধবার ইরাকে দুটো মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। কিন্তু এখন যদি তারা সংযত থাকে এবং মানুষের সহানুভূতি আদায় এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পথে থাকে, তাহলে ইরান এই সঙ্কট থেকে লাভবান হতে পারে।
সামরিক বদলার পথে গেলে উল্টো ফল হতে পারে।
আমেরিকার বিরুদ্ধে যে কোনো সামরিক ব্যবস্থার পরিণতিতে অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল ইরান দীর্ঘমেয়াদি একটি লড়াইয়ের চক্রে পড়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলেছে আমেরিকা। কোনো যুদ্ধ ইরানকে আরো একঘরে করে ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্র
কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করে ইরানের সামরিক দম্ভকে অনেকটাই আঘাত করতে সমর্থ হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনাও হয়তো অনেকটাই বাড়িয়েছেন তিনি। একইসাথে, মধ্যপ্রাচ্যে তার মিত্রদের, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। তবে ইরানের সাথে হিংসা-প্রতিহিংসার দীর্ঘমেয়াদি কোনো চক্রে পড়ে গেলে তা মি. ট্রাম্পের জন্য সঙ্কট তৈরি করতে পারে। কারণ তাতে করে তেলের দাম বাড়বে, মার্কিন নাগরিকের প্রাণহানি হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে হয়তো ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধের সূচনা হবে। শুধু আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দেশের ওপরই তার গুরুতর প্রভাব পড়বে।
ইরাকে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী
এই সঙ্কট থেকে স্বল্প মেয়াদে হলেও ইরাকে ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো লাভবান হতে পারে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দুর্নীতি এবং অপ্রতুল নাগরিক সুযোগ সুবিধার প্রতিবাদে ইরাকে সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। সেসময় ইরানের প্রভাব নিয়েও অনেক ইরাকি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বিক্ষোভে হামলার জন্য ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে।
কিন্তু এখন এই সব মিলিশিয়া গোষ্ঠী এবং সেই সাথে ইরাকের সরকার সোলেইমানির হত্যাকাণ্ডকে কাজে লাগিয়ে জনগণের সামনে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছে যে ইরাকের সার্বভৌমত্বের জন্য এইসব গোষ্ঠীর অস্তিত্ব জরুরী।
শিয়া এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো বহুদিন ধরেই চাইছে মার্কিন সৈন্যরা যেন ইরাক ছেড়ে চলে যায়। সোলেইমানির মৃত্যুতে তাদের সেই দাবি জোরদার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ইসরায়েল
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে বৈরিতা বহুদিনের। ইসরায়েল মনে করে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে বড় হুমকি ইরান। লেবাননে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হেযবোল্লার প্রতি ইরানের সমর্থন এবং সিরিয়ায় ইরানের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে ইসরায়েল সবসময়ই উদ্বিগ্ন।
কিন্তু সোলেইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমেরিকা ইঙ্গিত দিয়েছে তারা ইরানকে বাগে আনতে বদ্ধপরিকর।
ইসরায়েলের স্বার্থের জন্য জন্য এটা ইতিবাচক। সেদেশের প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে বলেছেন যে তার দেশে আমেরিকার সাথে থাকবে।
সৌদি আরব-সংযুক্ত আরব আমিরাত
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব-আমিরাত বা ইউএই নাজুক একটি পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। গত বছর হরমুজ প্রণালীতে তেলের ট্যাংকারের ওপর হামলার শিকার হয়েছে এই দুই দেশ।
তারপর সেপ্টেম্বরে তাদের তেল স্থাপনার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্যও ইরানকে সন্দেহ করে সৌদি আরব। চাপে পড়ে, ইউএই চেষ্টা করছে যাতে ইরানের সাথে সম্পর্কে উত্তেজনা কমে। কিন্তু সৌদি আরব চায় আমেরিকা যেন ইরানের ওপর চাপ বাড়ায়। কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডের পর এই দুই দেশ উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছে। সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কথা বলতে ওয়াশিংটন গেছেন।
ভৌগলিক নৈকট্য এবং সম্পর্কের ইতিহাসের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো বড় যুদ্ধে ইরানের কাছ থেকে আঘাত আসার ঝুঁকি এই দুই দেশের ওপরেই রয়েছে।
ইউরোপ
ইরানের সাথে করা পারমাণবিক চুক্তিটি রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউরোপ। ফলে, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিপজ্জনক এই পরিস্থিতি ইউরোপকে নতুন বিড়ম্বনায় ফেলেছে। কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার আগে ব্রিটেনকে জানায়নি আমেরিকা। এই ঘটনা প্রমাণ করে আটলান্টিকের দুই পারের মধ্যে টানাপড়েন কোন পর্যায়ে গেছে। কিন্তু আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে ব্রিটেন সহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের সৈন্য রয়েছে ইরাকে। ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক লড়াই শুরু হলে, এই পশ্চিমা দেশগুলো ক্রসফায়ারের মাঝে পড়ে যাবে, এবং সন্দেহ নেই ইউরোপ সে কারণে চিন্তিত।