ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী ॥ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গড়ে তোলার নির্দেশ

37
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও আদর্শের নীতি ধারণ করে সততা, নিষ্ঠা ও নীতি নিয়ে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, সততা-নীতি ও আদর্শ ছাড়া কোন নেতা গড়ে উঠে না। সততা-আদর্শ ছাড়া সফলতা আসবে না। সাময়িকভাবে নামডাক আসতে পারে, অর্থবিত্ত হতে পারে। কিন্তু আদর্শহীন রাজনীতি করলে তারা দেশের কোন কল্যাণ করতে পারেন না, দেশ ও জাতিকে কিছু দিতে পারেন না, এমনকি রাজনীতিতেও টিকে থাকতে পারেন না। দেশের ইতিহাসে মনে রাখার মতো কিছু করতে পারবেন না। তাই ছাত্রলীগকে আদর্শভিত্তিক এবং সততা-নীতি ও আদর্শ নিয়ে চলতে পারে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্রলীগের দীর্ঘ ঐতিহ্য ও গৌরব নিয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে।
শনিবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের ৭২ বছর, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও বর্ণাঢ্য পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশ থেকে আগত সংগঠনটির নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আরও বলেন, নীতি ও আদর্শ নিয়ে চলার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের পাশাপাশি ছাত্রলীগকে একটি মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কেননা দেশের যে কোন ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সারাদেশে একটা সংগঠন
হিসেবে ছাত্রলীগের যে ঐতিহ্য ও অবদান রয়েছে, সেটা প্রতিটি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর মনে রাখা উচিত। সেটা মনে রেখেই ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে তাদের আচরণ, কথাবার্তা ও রাজনীতি সেভাবেই করা উচিত, যাতে এ সংগঠন একটা মর্যাদাপূর্ণ হয় এবং দেশ ও জাতির কাছে আস্থা অর্জন করে চলতে পারে। ’৭৫ পরবর্তী জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার আমলে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে ছাত্রদের লাঠিয়াল ও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগের হাতে কাগজ ও কলম তুলে দিয়েছিলাম, আর খালেদা জিয়া ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন ক্ষমতায় টিকে থাকতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া সবাই ছাত্রদের হাতে অস্ত্র, অর্থ তুলে দিয়ে অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু আমরা চাই, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নীতি-আদর্শ নিয়ে নিজেদের গড়ে তুলে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ছাত্ররাই আমাদের ভবিষ্যত। আগামীতে তারাই দেশের নেতৃত্ব দেবে। ভবিষ্যতে তারাই দেশকে পরিচালনা করবে। কিন্তু তাদের যদি বিপথে নামানো হয়, নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য তাদের (ছাত্র) ব্যবহার করা হয়, তাহলে তারা দেশকে কীভাবে নেতৃত্ব দেবে? অতীত সামরিক স্বৈরশাসকসহ খালেদা জিয়ারা ছাত্রদের বিপথে চালিত করে সন্ত্রাস-অস্ত্রবাজি-জঙ্গীবাদ সৃষ্টির মাধ্যমে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছে। শিক্ষাঙ্গনকে তারা সন্ত্রাসীদের জায়গায় পরিণত করেছিল। আমরা চাই না কোন ছাত্র আর কোনদিন বিপথে চালিত হোক। আমি চাই, ছাত্রলীগ যেন সবসময় নীতি বজায় রেখে রাজনীতি করে। জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ছাত্রলীগকে কাজ করে যেতে হবে।
ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সভাপতিত্বে এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টচার্যের সঞ্চালনায় ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী প্রবীণ নেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী, ৬৯-৭০ সালে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব তৎকালীন ডাকসু ভিপি বর্ষীয়ান জননেতা তোফায়েল আহমেদ ও ’৭৫ পরবর্তী চরম দুঃসময়ে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বদানকারী সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। অনুষ্ঠানে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখককে ভারমুক্ত ঘোষণা করে তাদের ছাত্রলীগের পূর্ণ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। তবে শুদ্ধি অভিযানের সময় নানা বিতর্কে জড়িত থাকায় অব্যাহতিপ্রাপ্ত সদ্য সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানীকে দাওয়াত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, এমনকি তাদের পরিচয়ও করিয়ে দেয়া হয়নি।
বেলা আড়াইটায় জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, ঢাকা মহানগর, ওয়ার্ড এবং সারাদেশের জেলা-মহানগর-উপজেলা থেকে আগত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বর্ণাঢ্য মিছিল আসতে থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই মূল প্যান্ডেল উপচিয়ে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত বিশাল দৃষ্টিনন্দন মঞ্চে আসন গ্রহণের পর প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। উত্তরীয় ও ব্যাজ পরিয়ে দেন ইশাত কাসফিয়া ইরা, বেনজির নিশি, জেসমিন শান্তা। পরে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান হৃদয় এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত দাশ ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বই তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
এরপর ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির উদ্যোগে পরিবেশিত করা হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মাহমুদুল হাসানের পরিচালনায় ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক কমিটির নেতাকর্মীরা দুটি দেশাত্মবোধক গান ‘ধন্য ধান্য পুষ্পে ভরা.. এবং পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবে কী রে হায়..’ গান পরিবেশ করেন। সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক জসিম উদ্দিন পরিবেশন করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা স্বরচিত গান। এ সময় শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সংক্ষিপ্ত নাটিকা ছাড়াও প্রতিষ্ঠার গত ৭২ বছরে ছাত্রলীগের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, সাফল্যে নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। দেশাত্মবোধক গানের সময় নিজেও গানের সঙ্গে সুর মেলান ছাত্রলীগ থেকেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সাল আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করছে। এই বছরের ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী আমরা পালন করব। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একবছর আমরা ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছি। ছাত্রলীগ হচ্ছে জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার। একমাত্র আওয়ামী লীগই যে পারে, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে, তা আমরা জাতির সামনে প্রমাণ করেছি। তাই ছাত্রলীগকে সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলতে হবে, কাজ করে যেতে হবে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্মলগ্ন থেকে গত ৭২ বছরে ছাত্রলীগের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, দেশের যে কোন ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রলীগ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ ও নেতৃত্বেই ফজলুল হক হলে সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল। আর বঙ্গবন্ধুই বলেছিলেন- ছাত্রলীগের ইতিহাসই হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাস। এটি মাথায় রেখেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে, ছাত্রলীগকে একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন হিসেবে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে আরও বলেন, জিয়াউর রহমান, এরশাদসহ যারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে খালেদা জিয়াসহ তারা ছাত্রদের হাতে অস্ত্র, মাদক তুলে দিয়ে সন্ত্রাস, মানি লন্ডারিং অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতাকে বৈধ করার একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এইভাবে বহু মেধাবী ছাত্রের জীবন তারা নষ্ট করেছে। এমনকি সাত খুনের আসামি সাজাপ্রাপ্ত আসামি তাকে ছেড়ে দিয়েও রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে রাজনীতিতে পুনর্বাসনসহ একটা সুস্থ রাজনৈতিক ধারাকে বার বার নষ্ট করার প্রচেষ্টা এরা সব সময় করেছে। যারাই এ রকম অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে আমরা জিয়াউর রহমান বলি, এরশাদ বলি এমনকি খালেদা জিয়া সব সময় আমরা দেখেছি তারা এই মেধাবী ছাত্রদের ব্যবহার করেছে লাঠিয়াল বাহিনী, অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদ, মাদক, মানি লন্ডারিং নানাভাবে তাদের ব্যবহার করা এবং তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসেবে।
ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়ার ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুও ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে উঠে এসেছেন কিন্তু তিনি একটা দেশ দিয়ে গিয়েছেন, স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছেন। এটা দিতে পেরেছেন কারন জাতির পিতার শক্তি ছিল সততা, সাহস নীতির শক্তি। তিনি কখনও নীতির সঙ্গে আপোস করেননি। যেটাকে তিনি সত্য বলে মনে করেছেন সেটার জন্য তিনি সর্বদা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন।
এ সময় যারা রাজনৈতিক নেতা হওয়ার আকাক্সক্ষা করেন, স্বপ্ন দেখেন- তাদের প্রত্যেকেরই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়া উচিত মন্তব্য করে করেন প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে চান বা গবেষণা করতে চান বা ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে জানতে চান তাদের জন্য পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লেখা যেসব ফাইল ও নথি রয়েছে তা আমরা ১৪ খ-ে বই আকারে প্রকাশ করছি। সেখানে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সব রিপোর্ট লেখা। পাকিস্তানী শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে কোন চোখে দেখত সেটা সেখানে আছে। এটা প্রকাশ করলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিতে চেয়েছিল অনেকে। তারা বলার চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে ছিলেন, তাহলে কিভাবে ভাষা আন্দোলন করে? কিন্তু জাতির পিতা তো রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়েই তো গ্রেফতার হয়ে তিনি জেলে গিয়েছিলেন। ভাষার পক্ষে আন্দোলন করার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাঁকে আপোস করতে বলা হলেও তিনি আপোস করেননি, যার কারণে তিনি আইনে পড়ালেখা শেষ করতে পারেন নাই। বঙ্গবন্ধু সবসময় নিজে কি পেলেন সেটা না ভেবে, জনগণ কি পেল সেটা ভাবতেন। বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের মূল লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানীদের একটা প্রবণতা ছিল আমাদের বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতিসহ সবকিছু কেড়ে নেয়ার। তারা শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলতে বাধা দিয়েই ক্ষান্ত হয় নাই, তারা এরকম ফরমান জারি করেছিল যে বাংলা অক্ষর পরিবর্তন করে আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখতে হবে। এর বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তা ছাত্রলীগকে দিয়েই শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এর পরে যে সংগ্রাম হয়েছে সেখানে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো।
তিনি বলেন, ১৯৬৬ সালে ছয়দফা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং ছাত্রলীগকে দিয়ে কাজ করিয়েছিলেন। জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে মানুষের মাঝে চেতনা তৈরি করে জনগণকে সেটা গ্রহণ করানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন ছাত্রলীগকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পতাকা কেমন হবে তা নিয়ে ঘরোয়া আলোচনা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- জাপান উদিত সূর্যের দেশ তাই তাদের পতাকা সাদার মাঝে লাল সূর্য, আর আমরা সবুজ বাংলাদেশ তাই আমাদের পতাকা হবে সবুজের মধ্যে লাল সূর্য। তিনি বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এর প্রথম প্রতিবাদ এই ছাত্রলীগের ছেলেরাই করেছিল। ছাত্র ইউনিয়নসহ আর কিছু সংগঠন একসঙ্গে প্রতিবাদ করে। সেই সময় আমরা দুবোন শরণার্থী হিসেবে বিদেশে ছিলাম, আমাদের দেশে ফিরে আসতে দেয়ার দাবিও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে করা হয়। একই সঙ্গে যুবলীগও দাবি করে আর আওয়ামী লীগ থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী সাহেব সংসদে দাবি করেছিলেন। তাই সারা বাংলাদেশে একটা সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের যে ঐতিহ্য ও অবদান সেটা প্রতিটি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর মনে রাখা উচিত। আচরণ, কথাবার্তা ও রাজনীতি সেভাবেই করা উচিত যাতে এই সংগঠন একটা মর্যাদাপূর্ণ হয় এবং দেশ ও জাতির কাছে আস্থা অর্জন করে চলতে পারে। তাই আমি চাই, ছাত্রলীগ যেন সবসময় নীতি বজায় রেখে রাজনীতি করে। জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞেও ছাত্রলীগকে কাজ করে যেতে হবে।
ছাত্রলীগের দুর্নাম শুনলে মাথা হেঁট হয়ে যায় : ষাটের দশক থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসা সাবেক ছাত্রনেতারা সংগঠনটির দীর্ঘ ঐতিহ্য-সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, এখন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর বিতর্কিত কর্মকা- যখন খবরের শিরোনাম হয়, তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। এসব বিতর্কিত কারোর ছাত্রলীগে প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ত্যাগের ইতিহাস দেখে সেভাবেই নীতি-আদর্শ ও সততার সঙ্গে ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।
৬৮-৬৯-এ পাকিস্তান শাসনামলের দুঃসময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা বর্তমানে প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খালেদ মোহাম্মদ আলী সংগঠনটির দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ওই সময় ছাত্রলীগের কাছে কোন পয়সা ছিল না। মাত্র দু’পয়সা দিয়ে কালি কিনে পোস্টার লিখে সাঁটিয়েছি, হেঁটে হেঁটে পত্রিকা অফিসগুলোতে গিয়ে প্রেস রিলিজ পৌঁছে দিয়েছি। সারাদেশে অনেক কষ্ট শিকার করে সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে কাজ করেছি।
আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের জন্ম দেন। কিন্তু সেই ছাত্রলীগ সম্পর্কে এখন অনেক কথায় কানে আসে। তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়, কিছু বলতে পারি না। কিন্তু আমাদের সময় কেউ বলতে পারেনি ছাত্রলীগ চাঁদা চায়, পয়সা চায়। আর ক’দিনই বা বেঁচে থাকব, আমাদের অগ্রজরা সবাই মারা গেছেন। তাই ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীদের প্রতি অনুরোধ, সততা-নিষ্ঠা ও আদর্শ নিয়ে চলে মানুষের হৃদয় জয় করতে হবে।
৬৯’-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম পুরোধা, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রবীণ জননেতা তোফায়েল আহমেদ সংগঠনটির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ছাত্রলীগের জন্মের মাধ্যমেই স্বাধীনতার বীজবপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৭ হাজার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে জাতির পক্ষ থেকে তাঁর শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণার স্মৃতিরোমন্থন করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুটি স্বপ্ন ছিল- এক স্বাধীনতা, অন্যটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। আজ তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। তিনি আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সকল সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে একাট্টা হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যে কোন কারণে ছাত্রলীগের সুনাম কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের ছাত্রলীগে প্রয়োজন নেই। সেই ছাত্রলীগ কর্মীর প্রয়োজন নেই, যে আবরার হত্যায় জড়িত, রাজশাহীতে অধ্যক্ষকে অপমান করে। তাই ছাত্রলীগের হারিয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে। সংগঠনকে সুনামের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের দূরে যেতে হবে না। সততার শিক্ষা আমরা বঙ্গবন্ধু পরিবারেই পাই। মেধা এখানে। সততা-নিষ্ঠা-আদর্শ এবং মেধা বঙ্গবন্ধু পরিবারে। আসুন এই পরিবার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা সবাই এগিয়ে যাই।
এ সময় মঞ্চে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, ইসমত কাদির গামা, বাহালুল মাজনুন চুন্নু, ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, খ ম জাহাঙ্গীর, আবদুল মান্নান এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ এমপি, আবদুর রহমান, শাহে আলম, অসীম কুমার উকিল এমপি, মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, হুইপ ইকবালুর রহিম, উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, ইসহাক আলী খান পান্না, বাহাদুর বেপারি, অজয় কর খোকন, লিয়াকত সিকদার, নজরুল ইসলাম বাবু এমপি, মাহমুদ হাসান রিপন, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ, মোঃ সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসাইন।