জাতীয় পার্টির নবম কাউন্সিল আজ ॥ জিএম কাদের চেয়ারম্যান, রওশন প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত মান-অভিমান আর বিরোধের বরফ গলেছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে। আজকের নবম কাউন্সিল ঘিরে বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের সমঝোতার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত কমিটি ঘোষণা হতে যাচ্ছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাদের চাপের মুখে শুক্রবার উভয়পক্ষের মধ্যে এ সমঝোতা হয়। দলের অন্তত ১০ প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং মহাসচিব ও যুগ্ম মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত এবারের জাতীয় সম্মেলনে চেয়ারম্যান থাকছেন জি এম কাদের। সবকিছু ঠিক থাকলে এবারই তিনি প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছেন। তবে সম্মেলনে বর্তমান সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে দেয়া হচ্ছে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ। এছাড়া মহাসচিবের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে না। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মশিউর রহমান রাঙ্গাই বহাল থাকছেন এ পদে।
দলটির নেতারা জানিয়েছেন, শুক্রবার সম্মেলনের আগে দলের সর্বশেষ প্রেসিডিয়াম বৈঠকে গঠনতন্ত্রে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। মূলত দলে বিরোধ কমাতেই এ ধরনের পরিবর্তন বলছেন শীর্ষ নেতারা। জানা গেছে, বিরোধ মেটাতে গঠনতন্ত্রে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান একটি ও চারটি কো-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ছাড়া আট বিভাগের জন্য অতিরিক্ত মহাসচিবের আটটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। যা আজকের সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়ার কথা আছে।
জানা গেছে, সম্মেলনে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান পদ দেয়া হচ্ছে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে। কো-চেয়ারম্যান থাকছেন, সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশিদসহ আরও একজন।
জাপার নীতি নির্ধারকরা জানিয়েছেন, সম্মেলনে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চেয়ারম্যান পদে নাম ঘোষণা করা হবে। এর বাইরে সর্বোচ্চ মহাসচিব পর্যন্ত নাম ঘোষণা করা হতে পারে। এর বাইরে কমিটির অন্য সদস্যদের নাম পরবর্তিতে বিভিন্ন পর্বে ঘোষণা করা হবে। রওশন-জিএম কাদেরসহ ১০ সদস্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে পূর্ণাঙ্গ কমিটির নাম চূড়ান্ত করবেন বলে জানা গেছে। যদিও দলের অন্য পদে নেতাদের নাম ঠিক করার গঠনতান্ত্রিক এখতিয়ার জিএম কাদেরের হাতে।
দলটির প্রেসিডিয়ামের একাধিক সদস্য জানান, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত আলোচনা ছিল এবারের কাউন্সিলে রওশন এরশাদই হচ্ছেন পার্টির চেয়ারম্যান। মূলত রওশনপন্থী অন্তত ১০ শীর্ষ নেতা এ বিষয়ে অনেকটাই অনড় ছিলেন। তাদের পরামর্শে রওশনও চেয়ারম্যান হতে সম্মত ছিলেন। কিন্তু শুক্রবার দলের প্রেসিডিয়াম বৈঠকে অনেক নেতা দলের ভবিষ্যত তুলে ধরে বিরোধ মিটিয়ে একসঙ্গে পথ চলার জন্য আবেগঘন বক্তব্য দেন। সেইসঙ্গে সারাদেশে নেতাকর্মীদের মতামত বৈঠকে তুলে ধরা হয়। যার প্রেক্ষিতে শীর্ষ নেতারা মত দেন রওশনকে সম্মানজনক পদ দেয়ার। পাশাপাশি দলের সিনিয়র নেতাদের জন্য সম্মানজনক পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আসে। যার প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত প্রধান পৃষ্ঠপোষক, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত মহাসচিবসহ চারটি নতুন পদ সৃষ্টি করে বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়া হয়েছে।
জিএম কাদেরপন্থী দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, ম্যাডামকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে সর্বোচ্চ সম্মানিত পদে বসানো হচ্ছে। তার পরামর্শে পার্টির চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি পরিচালনা করবেন। শুধু তাই নয় এতদিন রওশনপন্থীসহ দলের শীর্ষ পর্যায়ের যেসব নেতা অখুশি ছিলেন সবাইকে খুশি করতে দলের কো-চেয়ারম্যান পদ বাড়ানো হয়েছে, নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে অতিরিক্ত মহাসচিব পদের। এসব পদে তাদের দেখা যাবে।
মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টিতে সর্বোচ্চ সম্মানিত পদে অধিষ্ঠিত করা হচ্ছে। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন দলের এই পদে এককভাবে অধিষ্ঠিত থাকবেন, তার মৃত্যুর পরে পদটি আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে না, বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনিই হবেন দলের শীর্ষনেতা। দলের যেকোন পাবলিক মিটিংয়ে চেয়ারম্যানের উপরের মর্যাদা ভোগ করবেন তিনি। এছাড়া দলীয় পতাকা একমাত্র তার গাড়িতেই থাকবে।
বৈঠক শেষে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি বলেন, আজ নেতাকর্মীদের আনন্দের দিন। তারা যা চেয়েছেন সেটাই হয়েছে। আমরা সবাই জিএম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি। ম্যাডামের নির্দেশনায় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের জাতীয় পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রেসিডিয়ামের সভায় দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন, মহাসচিব নির্বাচন, কো-চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত মহাসচিবসহ নতুন কমিটি গঠনে বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। সেটি সম্মেলনে পাস করিয়ে নেয়া হবে। সভায় গঠনতন্ত্র সংশোধন উপ-কমিটির আহ্বায়ক সুনীল শুভরায় সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি ও রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। গত ২০১৬ সালে মার্চে পার্টির অষ্টম কাউন্সিলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কো-চেয়ারম্যানের পদ তৈরি করে তাতে ভাই জি এম কাদেরকে আসীন করেন। স্ত্রী রওশন এরশাদ তাতে ক্ষিপ্ত হলে পরে তার জন্য এরশাদ তৈরি করেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যানের পদ। রওশন আর জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব তখন থেকেই।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চলতি বছরের ৫ মে তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। পরে ১৪ জুলাই ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এরশাদ। এর চার দিনের মাথায় বনানীতে পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন। রওশনপন্থীরা পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনেন।
পরে দু’পক্ষের সমঝোতা হলে ৮ সেপ্টেম্বর আরেক সংবাদ সম্মেলনে রাঙ্গা জানান, জিএম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবেন। আর রওশন এরশাদ হবেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা।
সমঝোতার পর রওশনকে সংসদ অধিবেশেন দেখা গেলেও দলের কার্যক্রম থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। এই দূরত্ব ঘোচাতেই দলের নবম কাউন্সিলে ‘সর্বোচ্চ সম্মান’ দিয়ে তাকে নতুন পদে বসানোর পরিকল্পনা হয়েছে বলে আভাস দিলেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা। রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত একাধিক নেতা বলেন, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ নিতে রওশন এরশাদেরও ‘সায় আছে’।