ইসলামে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব নিরসন

29

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

১২৫ বছর আগে ১৮৮৬ সালে ও বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য ছিল খুব কম। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা শ্রম দিয়েও শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি পেত না। অনেক শ্রমিক পরিবারের শিশুসন্তান পিতাকে চিনতে পারতো না। কারণ শিশুটি যখন ঘুমিয়ে থাকতো পিতা কর্মস্থলে চলে যেত, পিতা যখন ঘরে ফিরতো তখন শিশুটি আবার ঘুমিয়ে পড়তো। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনেক শিশু তার মায়ের পাশে বসা পিতার দিকে এমনভাবে তাকাতো যেন এই পুরুষ মানুষটি বাইরের মানুষ। ১২ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে শ্রমজীবীদের স্বছন্দে সচ্ছলভাবে সংসার চলতো না। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতো না। তারা অদৃষ্টের বিধান হিসেবে এ অত্যাচার-অবিচার মেনে নিয়েছিল। মানুষ বোবা পশু নয় তাদের মনে ভাব জাগে, মুখে ভাষা জাগে। এক সময় তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠলো।
চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটলো আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। তারা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলো। মালিকপক্ষ সব দেশে সবকালেই মনে করে তারা আলাদা জাত। তারা শ্রমিকদের উপর শোষণ করে, নির্যাতন করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের উপর গুন্ডা লেলিয়ে দেয়। শিকাগো শহরেও তাই ঘটেছিল। মালিক পক্ষের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হলো। তাদের মৃত্যু বৃথা যায়নি। দেশে দেশে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়লো। বিভিন্ন দেশের সরকারও এগিয়ে এলো। তারা দেশের শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার প্রয়োজনে কলে-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা-বৈঠক করে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের মেয়াদ ৮ ঘণ্টা করার দাবি মেনে নিল। ১৮৮৬ সালের এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি পূরণের দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলো। মে মাসের পহেলা তারিখ বিশ্বের সব দেশে শ্রমজীবী মানুষ ছুটি পালন করে। সভা-সেমিনারের মাধ্যমে নিহত শ্রমিকদের আত্মত্যাগের কথা জীবন দানের স্মৃতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
যারা ১৮৮৬ সালে দরিদ্র শ্রমিকদের নির্বিচারে গুলী করে হত্যা করেছিল তারা এ নৃশংসতার পরিচয় কেন দিয়েছিল? এর মূলে ছিল ঐশ্বর্যের ক্ষুধা। এ ক্ষুধার কোন শেষ নেই। টাকা ও ক্ষমতা জন্য মানুষের চাহিদা অন্তহীন। টাকা নিজেই তার অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি করে। বিদ্যমান প্রয়োজন মিটে গেলে জন্ম হয় নতুন চাহিদার। এ ক্ষুধা মেটানোর জন্য মানুষ ন্যায়-অন্যায় বিচার করে না পাপ-পুণ্য বিচার করে না হালাল-হারাম বিবেচনা করে না। একজন ধনী মানুষকে তার ধনের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন কুছ বাপকা কুছ আপকা আউর কুছ পাপকা। অর্থাৎ কিছু সম্পদ পাওয়া গেছে পৈত্রিক সূত্রে কিছু নিজের উপার্জন আর কিছু পাপের ফসল। পাপ ও অনাচার সম্পদের বন্ধু ও দোসর।
একটা গল্প বলি। শিকারে গিয়েছিলেন দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিল। রাজকীয় হাতির হাওদায় তার সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গভীর অরণ্যে এক জায়গায় এসে তারা বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামলেন। হাতির হাওদা থেকে তারা বসলেন একটা গাছের নীচে। পরিশ্রান্ত হাতিও শুয়ে পড়লো। এ সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য সুলতানের নজরে পড়লো। ঝোপের একটা ব্যাঙ নীচে হাতিটি দেখে অস্থির হয়ে পড়লো। তার এলাকায় হাতি শুয়ে বিশ্রাম নেবে, ব্যাপারটি বুঝি সহ্য হলো না তার। কয়েক লাফে সে হাতির কাছে এসে হাতিটিকে কয়েকবার লাথি মেরে আবার নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর পর ব্যাঙটি এসে হাতিকে লাথি মেরে পরে একই জায়গায় গিয়ে বসছে দেখে সুলতান অবাক হলেন। হাতিকে লাথি মারার কারণটি সুলতান খুঁজে পেলেন না। মন্ত্রীর কাছে তিনি এর তাৎপর্য জানতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী তখন ব্যাঙটির কাছে গিয়ে দেখলেন যে একটা রৌপ্য মুদ্রার উপর শুয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী সুলতানকে এসে বললেন ব্যাঙটির আসলে কোন দোষ নেই। সে ঐশ্বর্যশালী। এই ঐশ্বর্য হারানোর আশঙ্কায় সে তার এলাকায় আসা হাতিকে শত্রু মনে করছে এবং তাকে লাথি মারছে। রূপোর একটি টাকা যদি একটি ব্যাঙকে এমন উদ্ধত ও দুর্বিনীত করতে পারে তাহলে মানুষের আচরণে অহঙ্কার না আসার কারণ নেই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করতেও নিরুৎসাহিত করেছেন।
তিনজন অনুচরসহ হযরত ঈসা (আ.) এর সফরে যাওয়ার এবং স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার এবং তার প্রতি তিনজন অনুচরের সীমাহীন লোভ পরিণামে তিনজনেরই মৃত্যুর ঘটনা সবাই জানে। একজনকে খাবার কিনতে পাঠানো হলে সে কেনা খাবারে বিষ মিশিয়ে অন্য দু’জনকে হত্যা করে নিজে যে সম্পদের একা মালিক হতে চেয়েছিল। অন্য দু’জন আধা-আধি নেয়ার পরিকল্পনা করে খাবার নিয়ে আসা লোকটিকে হঠাৎ আক্রমণে মেরে ফেলেছিল। পরে বিষ মেশানো খাবার খেয়ে দু’জন মারা যায়। পারস্যের সম্রার্যের ধনভান্ডার মদীনায় আনা হলে তা দেখে কেঁদেছিলেন হযরত ওমর (রা.)। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন এই ধন-সম্পদ ধ্বংস করেছে তার আগের মালিকদের। আমার ভয় হচ্ছে আমরাও এগুলোর প্রেমে জড়িয়ে পড়বো এবং পরিণামে শেষ হয়ে যাবো।
মালিক শ্রমিকবিরোধ চিরন্তন একটি সমস্যা। মালিকরা শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে অধিক কাজ করিয়ে নিতে চায়। অধিক উৎপাদন মানে অধিক মুনাফা অধিক অর্থ-সম্পদ। কিন্তু একজন পরিশ্রম করে অথচ ন্যায্য মজুরি পাবে না অন্যজন তাকে বঞ্চিত করে শ্রমের ফল ভোগ করবে এরকম সামাজিক ব্যবস্থা জুলুম। যারা এরকম জীবনব্যবস্থা সমর্থন করে বা কায়েম করতে চায় সেসব জালিমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা এবং জেহাদ করা ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। যারা অন্যের শ্রমের ফল অনাধিকারভাবে অন্যায়ভাবে ভোগ করে তারা জালিম। আল্লাহ জীবিকার উপাদান বিশ্বে ছড়িয়ে রেখে দিয়েছেন। বান্দা পরিশ্রম করে মহান রাজ্জাকের নিকট হতে রিযিক গ্রহণ করবে এটাই আল্লাহর বিধান। যে অন্যের শ্রমের ফলভোগ করে তার রিযিকদাতা হয়ে দাঁড়ালো ঐ ব্যক্তিকে জালিম রিযিকদাতা বানিয়ে দেয়, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ।
ইসলামী সমাজে সকল ব্যক্তিই শ্রমিক। হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলই ছিলেন শ্রমিক। অধিকাংশ নবী মেষ পালকের কাজ করেছেন। আমাদের নবীও মেষ চরাতেন। বিবি খাদিজার ব্যবসায় দায়িত্ব নিয়ে তিনি একাধিক দেশে গেছেন। তিনি কূপ থেকে পানি তোলার পারিশ্রমিক হিসেবে এক বালতির হিসাবে একটি করে খেজুর পারিশ্রমিক পেতেন। তিনি অন্যের ক্ষেতে পানি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকের মজুরি তার গায়ের ঘাম শুকাবার আগে দিয়ে দাও।
ইসলামী সমাজে শ্রমিকদের পানাহার এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা মালিকের মতো হতে হবে। গোলামের বা দাস-এর জীবনযাত্রায় মান সম্পর্কে ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট। মালিক যে রকম খাবার খাবে যে রকম পোশাক পরিধান করবে যে রকম বিছানায় ঘুমাবে গোলামকেও তাই দিতে হবে। বিদায় হজ্ব-এর ভাষণে রাসূল (সা.) দাস-দাসীদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন, তাদের ব্যাপারে তোমাদেরকে মহান আল্লাহর নিকট কৈফিয়ত দিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান হযরত ওমর (রা.) তালি দেয়া জামা পরিধান করতেন। বর্তমানে তালি দেয়া জামা গায়ে কোন সরকারি কর্মচারী তো দূরের কথা কোন ভিক্ষুকেরও দেখা যায় না। যে সময় খলীফার চেয়ে কম বেতনের কোন কর্মচারী ছিল না। খলীফা রাষ্ট্রের দরিদ্রতম ব্যক্তির চেয়ে উচ্চতর জীবন যাপন করতেন না। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রে জনগণ হলো রাষ্ট্রের মালিক খলীফা তাদের ভৃত্য। ভৃত্যের জীবনযাত্রার মান মালিকের চেয়ে উন্নত হতে পারে না। হযরত আবু বকর (রা.) কে পুরাতন কাপড় পরিয়ে কাফন দেয়া হয়েছিল। হযরত ওসমান (রা.) পিপাসার্ত অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেন। কারণ তাঁর বাড়িতে পানীয় জলের কোন কূপ ছিল না। বিদ্রোহীরা তাকে অবরোধ করে রেখে বাইরে থেকে পানি আনা বন্ধ করে দিয়েছিল। রাসূল (সা.) প্রবর্তিত অর্থব্যবস্থার মূল দর্শন হচ্ছে সমাজে ও রাষ্ট্রে সুষম ভারসাম্যপূর্ণ কার্যকর অর্থব্যবস্থার প্রবর্তন। রাসূল (সা.) বলেছেন, যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ সম্পদ রয়েছে তার উচিত অভাবগ্রস্তকে তা দিয়ে দেয়া। যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য ও পানীয় রয়েছে সে যার কাছে ওগুলো নেই তাকে দিয়ে দেবে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এভাবে বিভিন্ন সম্পদের কথা উল্লেখ করে বলতে থাকলেন। তখন আমাদের নিকট প্রতিভাত হলো আমাদের কারোরই প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদের উপর কোন অধিকার নেই। রাসূল (সা.) বলেছেন, দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমে যা উপার্জিত হয় তাই হচ্ছে উত্তম জীবিকা। শ্রমিকের সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ তার উপর চাপিয়ে দিতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন। (অসমাপ্ত)