আপীলে মৃত্যুদন্ড বহাল ॥ ফাঁসির দড়িতেই ঝুলতে হবে জামায়াত নেতা আজহারকে

50

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতেই ঝুলতে হচ্ছে আলবদর কমান্ডারকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও আলবদর কমান্ডার এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদন্ডের আদেশ বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্য বিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে মাত্র এক মিনিটে রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন। আপীল আংশিক মঞ্জুর হলেও তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। এই বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান। প্রায় পাঁচ বছর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তিন অভিযোগে এটিএম আজহারের মৃত্যুদন্ড এবং দুই অভিযোগে মোট ৩০ বছরের কারাদন্ড হয়েছে। এটি আপীল বিভাগের অষ্টম রায়। আপীল বিভাগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট মীর কাশেম আলীর মামলার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার তিন বছর দুই মাস পর এটিএম আজহারুল ইসলামের আপীলের রায়টি এলো। আইনজীবীসহ অন্যদের অভিমত এ রায়ে ইতিহাসের দায় মোচনে জাতির আরেক ধাপ অগ্রগতি।
এদিকে এটিএম আজাহারুল ইসলাম ছাড়াও আপীল বিভাগে আরও ৩০টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। যার মধ্যে সৈয়দ মোঃ কায়সারের মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হবার পর এ পর্যন্ত ৪০টি মামলার রায় প্রদান করেছে। ৪০টি মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে ৬৬ জনকে। আমৃত্যু কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে ২৪ জনকে। আরেকজনকে যাবজ্জীবন করাদন্ড প্রদান, একজনকে ৯০ বছরের দন্ড একজনকে ২০ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
রায়কে ঘিরে সুপ্রীমকোর্টের বাইরে এবং ভিতরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আজাহারের আপীল বিভাগের রায়ের পর এখন রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে হবে। যা কাদের মোল্লার রিভিউ রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এসব (যুদ্ধাপরাধ) মামলার আসামিরা সবাই একই কথা বলেছে যে তাদের রেসপনসিবিলিটি নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ মামলার প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী আজহারুল ইসলামকে যে তিনটি চার্জে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল, তার তিনটি চার্জই বহাল আছে এবং তার ফাঁসির রায়ও বহাল আছে। অন্যদিকে আসামির প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘চারজন জাজের ভেতরে তিনজন জাজ একমত হয়ে ফাঁসি বহাল রেখেছেন। আরেকজন দ্বিমত পোষণ করেছেন। এরপর আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে রিভিউ করব। আমরা আশাবাদী যে রিভিউতে অন্তত ফাঁসির আদেশটা থাকবে না।
আপীল বিভাগের নিয়মানুযায়ী সুপ্রীমকোর্ট এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ। আসামি পক্ষ পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে। রিভিউ খারিজ হলে শুরু হবে রায় কার্যকরের তোড়জোড়। রিভিউয়ে মৃত্যুদন্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে। রাষ্ট্রপতি প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ করলে নির্বাহী আদেশে যে কোন সময় দন্ড কার্যকর করা যাবে।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরধ ট্রাইব্যুনাল-১ একাত্তরে রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ৫টি অভিযোগই প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ৩টি অভিযোগে ফাঁসি, ২টিতে ৩০ বছরের কারাদন্ড ও একটিতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে ২ নম্বর, ৩ নম্বর এবং ৪ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির দন্ডাদেশ পেয়েছেন আজহার। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ অমানবিক অপরাধের দায়ে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে ৫ বছর কারাদন্ডাদেশ দেয়া হয়। আপীল বিভাগের রায়ে ২, ৩, ৪ (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে) ও ৬ নম্বর অভিযোগের দন্ড বহাল রাখেন। আর ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। এর আগে গত ১০ জুলাই এ আপীলের ওপর শুনানি শেষে সিএভি (রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান) রাখেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগ। ১৮ জুন আপীলের ওপর শুনানি শুরু হয়। আসামিপক্ষে এডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে এ শুনানি শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আজহারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ১২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শত শত বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ৯ ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের মধ্যে এক নম্বর বাদে বাকি পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ ছাড়াও তিনি যে আলবদর কমান্ডার ছিলেন তাও প্রমাণিত হয় বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে। ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ১১৩ যুক্তিতে আজহারকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপীল করেন তার আইনজীবীরা। আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০ পৃষ্ঠার মূলসহ ২৩৪০ পৃষ্ঠার আপীল দাখিল করেন।
পূর্ণাঙ্গ রায় শীঘ্রই : রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আজহারের পূর্ণাঙ্গ রায় শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে। নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আজহারুল ইসলামের করা আপীলের রায় ঘোষণার আগেই বিচারকরা তা লেখা ঘোষণা করেছেন। আশা করি এখন শীঘ্রই এই রায় প্রকাশ পাবে। রায় প্রকাশের পর দন্ড কার্যকর করা যাবে। আপীল বিভাগের রায়ের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করা হলে আমরা এর মোকাবিলা করব।
রিভিউ নিষ্পত্তির আগে রায় কার্যকর করা যাবে না : জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার পর তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে। এ রিভিউ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর করা যাবে না। খন্দকার মাহবুব বলেন, আজহারের বিরুদ্ধে সরাসরি অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার কোন অভিযোগ ছিল না। তিনি কখনও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি তখন ১৮ বছরের যুবক এবং কলেজের ছাত্র ছিলেন। সব অপরাধ পাকিস্তানী আর্মিরা করেছে।
কে এই আজাহারুল ইসলাম : বর্তমান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজাহারুল ইসলাম একাত্তরে বৃহত্তর রংপুরবাসীর কাছে ছিলেন এক আতঙ্ক। একাত্তরের তিনি রংপুর জেলা আলবদর কমান্ডার ছিলেন। আসামি নিজ এলাকা বদরগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে রংপুর সদরে জিলা স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণী পাস করেন। ১৯৬৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান শাখায় দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রংপুর কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান শাখায় দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে এইচএসসি (বিজ্ঞান) পরীক্ষায় যা ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে, উক্ত পরীক্ষার ফরম পূরণ করলেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কোন তথ্য মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাজশাহী হতে পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল হিস্ট্রিতে পাস করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে এমএ পাস করেন।
আসামি আজাহারুল ইসলামের ১ ছেলে, ৪ মেয়ে, ৪ ভাই ও ১ বোন রয়েছে। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে রংপুরের বদরগঞ্জ থানা ও কোতোয়ালি থানা নির্বাচনী এলাকার জামায়াতের প্রার্থী মোখলেসুর রহমান এবং একই সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বদরগঞ্জ-গঙ্গাছড়া থানা নির্বাচনী এলাকার জামায়াতের প্রার্থী মীর আফজাল হোসেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জামায়াতের সমর্থক এবং ছাত্র নেতা হিসেবে আজাহারুল ইসলাম উক্ত নির্বাচনী প্রার্থীদের পক্ষে এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আজাহারুল ইসলাম রংপুর কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যায়নরত ছিলেন। সেই সময়েই তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের (আইসিএস) রংপুর শাখার সভাপতি এবং রংপুর জেলার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসর্মপণের পর থেকে আজহারুল ইসলাম পলাতক ছিলেন। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আজহারুল ইসলাম ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-২ আসন থেকে জামায়াতে ইসলামীর দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রতিবারই পরাজিত হন।
এটি অষ্টম রায় : আপীল বিভাগে আজহারুল ইসলামের মামলাটি অষ্টম মামলা। এর আগে আপীল বিভাগে ৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এই সাতটি মামলার মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়। যার মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।