তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে দেন দরবার করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের স্থলভাগের ব্লকগুলোতে তেল গ্যাস অনুসন্ধান করতে দেন-দরবার করছে বহুজাতিক কোম্পানি। এককভাবে বাপেক্সকে দিয়ে স্থলভাগে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। সঙ্গত কারণেই স্থলভাগে কাজ পাওয়া সম্ভব নয় বুঝতে পেরে যৌথ উদ্যোগে আগ্রহ দেখানো হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর এ বিষয়ে বলেন, এভাবে কেউ প্রস্তাব নিয়ে এলেই সেই প্রস্তাবে সায় দেয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, যেখানে আমাদের রিগ বসে রয়েছে সেখানে কেন স্থলভাগে বহুজাতিক কোম্পানিকে কাজ দিতে হবে। কিভাবে বাপেক্স আরও গতিশীলভাবে কাজ করতে পারে সেই দিকে নজর দিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক মনসুর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পার্বত্য এলাকা এবং সাগরে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই সেখানে যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন। কিন্তু যেখানে আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে সেখানে যৌথ উদ্যোগের কোন প্রয়োজন নেই। এভাবে কোন কোম্পানিকে যৌথ অংশীদারিত্ব দিলে ওই ব্লকে শেয়ার তাদের ছেড়ে দিতে হবে। ব্লকগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ না পেলেও অর্ধেক বা আংশিক মালিকানা চলে যাবে বিদেশী কোম্পানির হাতে। ফলে এখন যেভাবে ব্লক ছেড়ে দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনে নিতে হচ্ছে সেভাবে তাদের কাছ থেকেও গ্যাস কিনতে হবে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত দেশটির একটি কোম্পানির নাম উল্লেখ করে ৮ এবং ১১ নম্বর ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করার আগ্রহ জানিয়েছে। রাষ্ট্রদূত তার চিঠিতে লিখেছেন জাপানের মিতসুই অয়েল এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি বাংলাদেশের ৮ এবং ১১ নম্বর ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধান করতে চায়। এক্ষেত্রে বাপেক্সের সঙ্গে তারা যৌথ অনুসন্ধান উত্তোলন করতে চায়।
জানতে চাইলে বাপেক্স এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোর্তজা আহমেদ ফারুক চিশতি বলেন, সাধারণত একটি দেশের জাতীয় কোম্পানিকে এমন সব ব্লক দেয়া হয় যেখানে সব থেকে বেশি সম্ভাবনাময়। কিন্তু বাপেক্স এর ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো। বাপেক্সকে অপেক্ষাকৃত কম সম্ভাবনাময় ব্লক দেয়া হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন বাপেক্সের সক্ষমতা রয়েছে। বহুজাতিক কোন কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের মাধ্যমে দেশের বাইরেও তেল গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলন করতে পারে। তিনি বলেন, বাপেক্সের অনুসন্ধান, খনন যন্ত্র সবই রয়েছে। নিজস্ব লোকবলও রয়েছে। ফলে যৌথ উদ্যোগ হলে তাদের মাধ্যমে দেশের বাইরে কাজ করার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বাপেক্স সূত্র বলছে মিতসুই ব্লক দুটিতে জয়েন্ট স্ট্যাডি পার্টনার হিসেবে কাজ করেছে। গত চার বছরে জয়েন্ট স্ট্যাডি পার্টনার হিসেবে কাজ করার জন্য বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাপেক্স এর একজন কর্মকর্তা জানান, ব্লক ৮ এবং ১১ তে বাপেক্স দ্বিতীয়মাত্রার ভূকম্পন জরিপ করেছে। এই অংশটি সম্ভাবনাময়। এখানে স্ট্যাডি পার্টনার হিসেবে মিতসুই কাজ করেছে। তবে তারা দ্বিতীয়মাত্রার ভূকম্পন জরিপের সঙ্গে ছিল না।
জাপানের রাষ্ট্রদূত তার চিঠিতে জানান, গত ১৬ জুলাই বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ ভাবে অনুসন্ধান উত্তোলনের প্রস্তাব দেয় মিতসুই। আর গত ১৮ জুলাই মিতসুইকে কাজ দিতে অনুরোধ জানিয়ে প্রথম দফা চিঠি দেন তিনি। চিঠিতে বলা হয়, এখন মিতসুই তাদের দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু করতে চায়। এই ধাপ বলতে উত্তোলন অনুসন্ধানে সমঝোতা স্মারক সই এবং যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনকে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রদূত।
বাপেক্সের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত এটি একটি কৌশল। এই কৌশলে এর আগেও অনেক কোম্পানি বাংলাদেশের স্থলভাগে কাজ করতে চেয়েছে। তারা পুরোপুরি ব্লক ইজারা না পেলেও ঠিকাদার হিসেবে চড়া মূল্যে কূপ খনন করার কাজ পেয়েছে। লাভজনক বিবেচনায় অন্য ব্লকগুলোর দিকেও নজর দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।
তারা বলছেন, স্থলভাগে দ্বিতীয়মাত্রার এবং তৃতীয়মাত্রার জরিপ কাজ বাপেক্স এখন সফলভাবে করছে। এই জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোও বাপেক্সের জরিপে কোন রকম ভুল রয়েছে প্রমাণ করতে পারেনি। ফলে গ্যাস অনুসন্ধানের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাপেক্স অনেক দিন আগে থেকেই সঠিকভাবে করছে। এর বাইরে বাপেক্স দীর্ঘদিন ধরেই সফলভাবে গ্যাস কূপ খনন করছে। এরপরও বহুজাতিক কোম্পানির দিকে ঝোঁকার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন বাপেক্স এর কর্মকর্তারা।
ব্লক ৮ এবং ১১ ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চলের পাশেই সিলেটে গ্যাসের বড় খনি রয়েছে। এই এলাকায় সুনেত্রতে গ্যাস পাওয়ার আশা দেখেছিল পেট্রোবাংলা। তবে একটি কূপ খনন করার পর কিছু পাওয়া না গেলে নতুন করে আর কাজ করেনি বাপেক্স। বলা হচ্ছে ওই এলাকায় আবার জরিপ করে তেল গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না তা দেখা উচিত।
জানতে চাইলে ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, যেখানে বাপেক্সে র সক্ষমতা নেই সেখানে যৌথ উদ্যোগে কাজ করা যেতে পারে। তবে যেখানে বাপেক্স সক্ষম সেখানে কেন যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্যচট্টগ্রামে অনুসন্ধান উত্তোলন কঠিন সেখানে যৌথ উদ্যোগে কাজ করা যেতে পারে কিন্তু ৮ এবং ১১ তে যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বাপেক্স যদি কোন বিষয় অভিজ্ঞ না হয় সেক্ষেত্রে বিদেশী পরামর্শকদের সহায়তা নিতে পারে। ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, ভারত তার দেশের যেসব নাগরিক অন্যদেশে বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে। আমরাও সে রকম পারি। তিনি বলেন, আমার জনামতে অনেক বাংলাদেশী কানাডাতে আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানিতে কাজ করছেন। যারা অভিজ্ঞ। তারা দেশের জন্য কাজ করতেও ইচ্ছুক। সরকার চাইলে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগতে পারে।
তেল গ্যাস অনুসন্ধানে এখন অর্থায়নও কোন সমস্যা নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করে দিয়েছে। গ্রাহক যে গ্যাস বিল পরিশোধ করে তার একটি অংশ এই উন্নয়ন তহবিলে জমা হয়। এখান থেকে অর্থ নিয়েই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। সরকার বা দাতা সংস্থার দিকে এখন আর অর্থায়নের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় না।