ঢাকায় তৃতীয় আইওরা সম্মেলনের উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী ॥ সমুদ্রের তলদেশের অনাবিষ্কৃত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বেষ্টনী গড়ে তুলুন

23
ইন্টারকন্টিনেন্টালে ৩য় তম ইন্ডিয়ান ওশ্যান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ) ব্লু ইকোনমি মিনিস্টেরিয়াল কনফারেন্মের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের ৩১ দেশের মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব সহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গ্রুপ ছবিতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইওআরএ (ইন্ডিয়ান ওশেন রিম এ্যাসোসিয়েশন) সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সমুদ্রের তলদেশের অনাবিষ্কৃত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে এই অঞ্চলে একটি অভিন্ন টেকসই সমুদ্র অর্থনৈতিক বেষ্টনী গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমুদ্র অর্থনীতি সামনে রেখে সমুদ্রে অব্যবহৃত ও এর তলদেশে অ-উন্মোচিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এই অঞ্চলে যার যার টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করার সুযোগ রয়েছে।’ খবর বাসস ও বিডিনিউজের। ‘সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে আমরা দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাসহ বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারি,’ যোগ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তৃতীয় আইওরা সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন’র (ব্লু ইকোনমি মিনিস্টেরিয়াল কনফারেন্স) আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে একথা বলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভারত মহাসাগর রিম এ্যাসোসিয়েশন (আইওরা) দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একীভূত টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির সর্বোচ্চ সুফল পেতে অংশীজনদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাই এ সম্মেলনেই যেন আমরা সম্মিলিতভাবে সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-১৪ অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি।’ শান্তি, নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়নের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খেয়াল রাখতে হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে যেন সমুদ্রের সুস্থ পরিবেশ বিঘিœত না হয়।’ ‘তাই আমাদের সমুদ্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সমুদ্র চিন্তাও করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে সমন্বিত, লাভজনক ও সর্বোপরি সমুদ্র সংরক্ষণমূলক নীতি নির্ধারণ ও সে অনুযায়ী কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হবে, বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আর তবেই ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ বিলিয়ন মানুষের জীবন ধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই সমুদ্র অর্থনীতিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।’ সরকারপ্রধান বলেন, আইওরা মেরিটাইম সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহায়তা, মৎস্য ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়তা, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সর্বোপরি সমুদ্র অর্থনীতির সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। তথাপি, নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আমরা কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। তিনি বলেন, আপনারা ইতোমধ্যেই আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমুদ্র শাসন, সম্পদ উন্মোচন ও আহরণের টেকসই পদ্ধতি, নৌপরিবহন, পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনসহ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, আইওরা সদস্যদের মধ্যে যে কর্মতৎপরতা ও উদ্যম সৃষ্টি হয়েছে তা নিকট ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। ২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অনুষ্ঠিত আইওরা লিডার্স সামিটে অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘সেখানে আমরা আইওরা’র নেতৃত্বে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়নে কাজ করার এবং সমুদ্রযান চলাচলের স্বাধীনতায় সম্মান দেখানোর অঙ্গিকার করেছিলাম।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আগামী ১ অক্টোবর দু’বছরের জন্য আইওরা’র সহ-সভাপতি এবং ১ অক্টোবর ২০২১ পরবর্তী দু’বছরের জন্য সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এই গুরুদায়িত্ব পালনে তিনি সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে বলেন, ‘সমুদ্র অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করতে আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করব।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম ‘সমুদ্র অঞ্চলের সীমা নির্ধারণ, সমুদ্র সীমানায় বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা ও সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য ‘দি টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স এ্যান্ড মেরিটাইম জোন এ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। তিনি বলেন, এই আইনটি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষণার আট বছর পূর্বেই বাংলাদেশে কার্যকর করা হয়। যখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ সম্পর্কে ততটা ধারণাই ছিল না। সরকারপ্রধান বলেন, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পগুলো যেমন- পণ্য পরিবহন, মৎস্য শিল্প, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ, নবায়নযোগ্য জ¦ালানি, সমুদ্রবন্দর, পর্যটন, মেরিন জেনেটিক রিসোর্সেস, মেরিন বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রাখছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ ও তেল পরিবহনের ৬০ শতাংশ এই সাগর-মহাসাগর দিয়েই হচ্ছে। বিগত ১৫ বছরে সমুদ্র বাণিজ্যের পরিমাণ ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে, বঙ্গোপসাগরে মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ, আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য আমাদের সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ-মেয়াদি কর্মপন্থা প্রণয়ন করেছে। তিনি বলেন, আমরা বছরের ৬ মাস মা ইলিশ ও মাছের পোনা আহরণ এবং সমুদ্রের নির্দিষ্ট অঞ্চলে বছরে ৬৫ দিন সকল প্রকার মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছি। অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ওপরে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ আমাদের জন্য বিশেষ সুফল বয়ে এনেছে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো মৎস্য উৎপাদনে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তার সরকার ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য রূপকল্প ২০৪১ প্রণয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০ নামে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্যি যে মনুষ্য-সৃষ্ট নানা কারণে আমাদের সাগর আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ, পরিবেশ দূষণ, তেল নিঃসরণ, প্লাস্টিক বর্জ্যরে দূষণ, শব্দ দূষণ এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তন এসবের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, এর ফলে সাগর ও মহাসাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য যে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে তাই নয়, বেশিরভাগ আইওরা সদস্যভুক্ত দেশগুলো সুনামি ও সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়। ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছে এবং মানব জাতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে’, বলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান বলেন, সাগর ও মহাসাগর গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত তাপের প্রায় ৯০ শতাংশই শোষণ করে থাকে। সমুদ্র বাস্তু ধ্বংস হলে মানবজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে উল্লেখ করে তিনি সকলে মিলে এই বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সকল প্রকার অপরাধমূলক কর্মকা- সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বুঝতে হবে যে, মহাসাগর ও তার বিপুল সম্পদ সংরক্ষণে আমরা যত বেশি বিনিয়োগ করব, যত বেশি পদক্ষেপ নেব তা সামগ্রিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী সুফল বয়ে আনবে। সমুদ্রের জৈব সম্পদ সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার মৎস্য আহরণের সকল প্রকার ক্ষতিকারক পদ্ধতি ও উপায়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ এবং অন্যান্য অপরাধ দমনেও কার্যকর আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী আশা পকাশ করেন, ‘আমাদের সবার কল্যাণে সমুদ্র অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জনে যে সকল বিষয় রয়েছে সেগুলো এই মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।’ তিনি বলেন, এছাড়াও আমি আশাবাদী যে এ সম্মেলন শেষে ‘ঢাকা ঘোষণা’ হিসেবে যা গ্রহণ করা হবে সেটি ভবিষ্যতে আমাদের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারব।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, আইওরা চেয়ারপার্সন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশ, বন এবং মৎস্য সম্পদ বিষয়ক উপমন্ত্রী মাখোতসো মেডেলিন সতিও, আইওরা মহাসচিব ড. নমভুভো এন.নকউই, আন্তর্জাতিক সিবেড কর্তৃপক্ষের মহাসচিব মাইকেল ডব্লিউ লজ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্র সম্পর্কিত ইউনিটের সচিব রিয়ার এ্যাডমিরাল (অব) খোরশেদ আলম স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি কূটনিতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দি ইন্টারগভার্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন (আইওরা-আইওআরএ) ১৯৯৭ সালে ভারত মহাসাগর তীরবর্তী ২১ দেশ নিয়ে গঠিত হয়। সদস্য দেশগুলো হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কমরস, ইন্ডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কেনিয়া, মাদাগাসকার, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিক, ওমান, সিশেলস, সিঙ্গাপুর, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইয়েমেন। জাপান, জার্মানি, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং মিসর আইওরা’র ডায়ালগ পার্টনার।