সংখ্যালঘু বলে নিজেদের খাটো করবেন না – প্রধানমন্ত্রী

89
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী মহোৎসব উপলক্ষে শ্রী শ্রী জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ও হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্টের নেতৃবৃন্দ সাক্ষাৎ করে প্রধানমন্ত্রীকে ক্রেষ্ট উপহার দিচ্ছেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেছেন, সংখ্যালঘু বলে নিজেদের খাটো করবেন না। অন্তত আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে আমরা ভাগ-বাটোয়ারা করে দেখি না। এই দেশ আপনাদের, এই মাটি আপনাদের, এই জন্মভূমি আপনাদের। আমি আপনাদের প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা কি এই রাষ্ট্রের নাগরিক না? তাহলে নিজেদের ছোট করে দেখবেন কেন? আওয়ামী লীগ ধর্মীয় ভেদাভেদে বিশ্বাস করে না, করবেও না। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন গণভবনে আয়োজিত জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা সব সময় বলি যে, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। বঙ্গবন্ধু আমাদের যে সংবিধান দিয়ে গেছেন সেখানেও কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা রয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশে সব ধর্মের স্বাধীনতা থাকবে। আমাদের সংবিধানের যে চার মূলনীতি সেখানেও তাই বলা আছে। আমাদের ধর্মেও তাই বলা হয়েছে, যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। যে কারণে আমি যখন মসজিদভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের চেষ্টা করলাম, তখন মন্দিরভিত্তিক শিক্ষাও চালু করি। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। আমরা ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছি। সেই সঙ্গে পুরহিত- সেবায়িতের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। খ্রীস্টান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম কল্যাণ ট্রাস্ট করে দিয়েছি আমরা। ট্রাস্টের পাশাপাশি শারদীয় দুর্গোপূজোয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আলাদা করে দুই কোটি টাকা দিয়ে আসছি।
শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত, সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি, জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের সভাপতি গৌরাঙ্গ দে, সাধারণ সম্পাদক বিমল কান্তি দে, এডভোকেট চন্দন তালুকদার, মহানগর সার্বজনীন পুজো উদযাপন পরিষদের সভাপতি শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার, হিন্দু ধর্মীয় ট্রাস্টের সুব্রত পাল, সাবেক নেতা দেবাশীষ পালিত প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করেছেন। বাবার পাশে ছায়ার মতো ছিলেন আমার মা। তাঁর নিজের জীবনেও কোন চাহিদা ছিল না। দাদা-দাদি বাবাকে সমর্থন করেছেন। ’৭৫ এ আমরা আপনজন হারিয়েছিলাম, বাঙালি হারিয়েছিল সব আশা-ভরসা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। সেই স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেয়া, বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল এই সব খুনী ও স্বাধীনতাবিরোধী, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা বলেন, বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি কাজ শুরু করেছিলাম। আজ এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছি। তাদের আশার আলো দেখাতে, তাদের ভেতরে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। আজ তারা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দখতে শুরু করেছে। এই দেশ আপনাদের। ১৯৯১ সালে মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে। আমরা ছুটে গিয়েছি। ঢাকার মন্দিরগুলোও ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে বৌদ্ধ ধর্মের লোকজনও রেহাই পায়নি। বিএনপির কাজই ছিল ধ্বংসাত্মক। সব সময় বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা অনেকেই অর্থশালী আছেন। নিজেরাও যদি ট্রাস্টে অনুদান দেন তাহলে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সেই টাকা দিয়ে অসুস্থ-দরিদ্রদের সহায়তা করা যেতে পারে। হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন খ্রীস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন করে দিয়েছি। সেখানে আমরা সিড মানি হিসাবে প্রথমে অনুদান দিয়েছিলাম তারপর আরও অনুদান বাড়িয়েছি। এখন সেখানে প্রায় ১০ কোটি টাকা জমা রয়েছে। এক্ষেত্রে আমি অনুরোধ করব, এখানে তো অনেকেই অর্থশালী সম্পদশালী আছে আপনাদের কল্যাণ ট্রাস্টে আপনারা নিজেরাও কিছু কিছু যদি অনুদান দেন তাহলে এখানে অর্থ আরও বৃদ্ধি পায় এবং তার মাধ্যমে আপনারা অসহায় দরিদ্র বা অসুস্থ মানুষকে সহযোগিতা করতে পারেন। আমি মনে করি, এটা সকলেরই দায়িত্ব, ট্রাস্টের অঙ্ক আরও বৃদ্ধি করা। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের মতো দিয়ে যাচ্ছি।
মুসলমান ধর্মে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি আইন তথা হেবা আইনের নারীদের অধিকারের সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মুসলমান ধর্মে মেয়েদের জন্য কিন্তু সম্পত্তিতে অধিকার দেয়া আছে। বাবার বাড়ির সম্পত্তিতেও যেমন আমার অধিকার আছে। স্বামীর বাড়ির সম্পত্তিতেও কিন্তু আমাদের অধিকার আছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মে সেটা ছিল না। আমরা সেখানে কিন্তু ইতোমধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তিটা রেজিস্ট্রেশন করা, আগেরকার সাধারণ আইনে করতে গেলে অনেক টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি লাগত। এ কথাটা যখনই আমাকে বলা হয়েছে তখনি আমাদের ওই হেবা মাত্র এক শ’ টাকা দিয়ে যেভাবে রেজিস্ট্রেশন করা যায়, আমরা সে ব্যবস্থাটা করে দিয়েছি। কারণ আপনার উত্তারাধিকার আপনার সম্পত্তি পাবে। সেখানে আবার আলাদা করে রেজিস্ট্রেশন ফ্রি বেশি দিতে হবে কেন? আর আমরা যদি সেটা ভোগ করি তাহলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেন সেই সুযোগটা ভোগ করবে না। অর্থাৎ সকলের সমান সুযোগ। এই সুযোগটা কিন্তু আমরা করে দিয়েছি। সকল ধর্মের জন্যই এটা করে দেয়া হয়েছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজায় বিশেষ অনুদান প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিল থেকে প্রতিবছর দুই কোটি টাকা দেয়া হয়ে থাকে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সব সময় এটাই লক্ষ্য থাকবে যে, আমাদের প্রত্যেকটা ধর্ম, আমাদের ঈদ বলেন, আপনাদের পুজো বলেন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা বলেন, অথবা বড়দিন। এখন আমার মনে হয় পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশেই বোধহয় সব থেকে বেশি এই ধর্মীয় একটা পরিবেশ এত সুন্দর আন্তরিক পরিবেশে প্রত্যেকটা ধর্মানুষ্ঠান সকলে মিলেমিশে আমরা উদযাপন করি। এখানে কিন্তু কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকে না। সবাই মিলেই সব অনুষ্ঠানে আমরা যাই।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের চরিত্রটাই এ রকম। কারণ আপনারা জানেন যে, তারা কিভাবে অত্যাচার করে, নির্যাতন করে, বিভিন্ন ঘটনার পর আপনাদের মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে, অত্যাচার করা হয়েছে। ১৯৯১ সাল আমার এখনও মনে আছে দুর্গম এলাকা সেখানেও মন্দিরগুলোতে হামলা করা হয়েছে, ভাঙ্গা হয়েছে। নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চরম অত্যাচর নির্যাতন হয়েছিল। তখন আমরা ছুটে গিয়েছি, সকলের কাছে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের কাজই ছিল এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানো। আর আমরা তো আক্রমণের শিকার মুসলমান তো আছেই। এইভাবে তারা সবসময় একটা বিভেদ সৃষ্টির করার এই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কখনও এতে বিশ্বাস করে না। আমরা মনে করি, এই দেশ সকলের।
হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, নিজেদের ওই সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু না বলে, এই মাটি আপনাদের, এই দেশ আপনাদের, এই জন্মভূমি আপনাদের। কেন নিজেদের মধ্যেই এই বিশ্বাস থাকবে না। অন্তত আওয়ামী লীগ যতদিন ক্ষমতায় আছে এবং আওয়ামী লীগ আছে তখন তো এইভাবে আমরা কখনও ওইরকম ভাগ বাটোয়ারা করে দেখি না প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই সকলে উপযুক্ত হলে সমান সুযোগ পাবে, সেটাই আমরা নিশ্চত করি। সেটা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। আমি সবসময় এটা শুনি এবং আমার খুব খারাপ লাগে যে আপনারা এভাবে নিজেদের কেন খাটো করে দেখবেন।
শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎসবটা ভালভাবে হোক। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা সবসময় তৎপর থাকে, এমনকি আমরা কমিউনিটি পুলিশিং করে প্রত্যেকটি এলাকায় এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা চালাই এবং সেখানে আপানদেরও সহযোগিতা চাই। কারণ দিনে দিনে পুজোর কিন্তু বাড়ছে। এটা মাথায় রাখতে হবে, যত বেশি বাড়বে ততবেশি নিরাপত্তা দিতে হবে। আপনারাও ভলান্টিয়ার ঠিক করবেন এবং প্রত্যেকটি জায়গায় যেন একটা শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে সেজন্য সহযোগিতা করবেন।