বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ॥ দেশ যেন আর কখনও সেই হায়েনাদের হাতে না পড়ে

43
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ (উত্তর ও দক্ষিণ) আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে ‘খুনীদের দল’ আখ্যায়িত করে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ যেন আর কখনও সেই হায়েনাদের হাতে না পড়ে। একজন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী খুনীর হাতে তৈরি রাজনৈতিক দল খুনী ছাড়া আর কি হতে পারে? বাংলাদেশ যে আজ উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে যাচ্ছে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা যেন আর থমকে না দাঁড়ায়। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে অনেক প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বিএনপি নেতারা এখন নতুন সাফাই গাইতে শুরু করেছে’ মন্তব্য করে বলেন, বিএনপি নেতারা এখন বলছে, ’৭৫ সালে তো বিএনপি গঠনই হয়নি, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যায় বিএনপি কীভাবে জড়িত হলো?
বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির যে প্রতিষ্ঠাতা, সেই জিয়াউর রহমান নিজেই খুনী। জিয়াউর রহমান শুধু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এই হত্যার যাতে বিচার না হয় সেই ব্যবস্থাও সে করেছিল। ইনডেমনিটি ছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল সেসব আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। আওয়ামী লীগের যারা বেইমান-মোনাফেক খুনী মোশতাকের সঙ্গে গিয়েছিল, তারা কোন না কোনভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের চক্রান্তে ছিল। যারাই মোশতাকের সঙ্গে ছিল তারা খুনের সঙ্গে জড়িত। পরবর্তীতে তারা জিয়ার সঙ্গে গিয়েছিল। এখন তাদের অনেকে বেঁচে আছে, তারা আবার বড় বড় কথাও বলে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ এমপির সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাত, উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান এমপি, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, দক্ষিণের সহ-সভাপতি আবু হানেফ মান্নাফী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল চৌধুরী, উত্তরের সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএ মান্নান কচি প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের প্রচার সম্পাদক আকতারুজ্জামান ও উত্তরের উপ-প্রচার সম্পাদক আজিজুল হক রানা।
এ সময় মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের মাসব্যাপী শোকের কর্মসূচীর শেষ দিন আজ শনিবার গণভবনে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা কখনও ভাবতে বা বিশ্বাস করতে পারেননি এদেশের কোন মানুষ তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাঁকে হত্যা করল কারা? এই দেশের মানুষ। তিনি কখনও বিশ^াস করেননি, এই দেশের মানুষ তাঁকে হত্যা করবে। যারা হত্যা করল, তারা আমাদের বাড়িতেই ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। বৌ, ছেলে, শাশুড়ি, মেজর ডালিম তো সারাদিন আমাদের বাড়িতে থাকত। খুনী নূর, ফারুকও যাতায়াত করত। তারা যে এই কাজ করবে, তা কেউ ভাবতেও পারেনি। মানুষ এমন বেইমানি করতে পারে তা ভাবতে পারিনি।
তিনি বলেন, ওই সময় বিশ্বনেতারা অনেক কিছু বলেছেন, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন। কিন্তু জাতির পিতা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছিলেন, আমার দেশের কেউ আমাকে কেন মারবে? তিনি এটা বিশ্বাসই করতে চাননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নাম পর্যন্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ৩ নবেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো। ’৭১ যেভাবে নারী ও শিশু হত্যা করা হয়েছিল, ঠিক ’৭৫-এর নারী ও শিশুদের হত্যা করা হলো। যেন কারাবালার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ধানম-ির ৩২ নম্বরে।
দীর্ঘ বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা ’৭৫-এর ১৫ আগষ্টে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার পরিবারের সদস্যদের স্মরণ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে সেদিন হারানো স্বজনদের নির্মম খুনের বর্ণনা দেন। এ সময় পুরো মিলনায়তন শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘটনার পরদিন (১৬ আগষ্ট) বনানী কবরস্থানে আমার মাসহ অন্যদের কবর দেয়া হয়। তাদের কাফনের কাপড় পর্যন্ত দেয়া হয়নি। আর বাবার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গিপাড়ায়। টুঙ্গিপাড়ার বাড়িটি সিলগালা করা হয়। সেখানেও কারফিউ জারি করা হয়। তখন কেউ ভিতরে যেতে পারেনি। কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, দোকানপাট ছিল বন্ধ। রেড ক্রিসেন্ট থেকে রিলিফের কাপড় এনে সেই কাপড় দিয়ে দাফন করা হয় আমার পিতাকে।
আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র ১৫ দিন আগে আমরা দুই বোন সবাইকে রেখে বিদেশে গিয়েছিলাম। কখনও ভাবতেও পারিনি যে নেতা আজীবন সংগ্রাম ও কষ্ট সহ্য করে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ ও মানচিত্র দিয়েছেন, তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) কেউ হত্যা করতে পারে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে যারা বিজয়ী জাতি হয়েছিল, সেই জাতি (বাঙালি) ‘খুনীর জাতি’ হিসেবে পরিচিত হলো। তিনি বলেন, পলাশীর যুদ্ধের সময় খুনী মীরজাফর বেইমানি করে ক্ষমতা নিয়ে তিন মাসও টিকতে পারেননি। তেমনিভাবে খুনী মোশতাকের কপালেও বেশিদিন সয়নি। মাত্র আড়াই মাসের মাথায় তাকেও বিদায় নিতে হয়েছিল। খুনের সঙ্গে যারা জড়িত, খুনিদের নিয়ে যে দল গঠন, সেই জিয়াউর রহমানের শাসকে উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ১৫ আগষ্ট শুধু একটা পরিবারকে হত্যা নয়, এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাস মুছে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে যার অবদান, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যত আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান তাও মুছে দেয়া হয়েছিল। তখন একটি মাত্র টেলিভিশন ছিল-বিটিভি। সেই বিটিভিতেও একটি বারের জন্য বঙ্গবন্ধুর নামটি আসেনি। একেবারে ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই ১৫ আগষ্টের খুনীদের মদদ দিয়েছে। যেভাবে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে খুনীদের দূতাবাসে চাকরি দিয়েছিল, ঠিক একইভাবে খালেদা জিয়াও পুনর্বাসন করেছেন। এরশাদও খুনীদের মদদ দিয়েছে, পুরস্কৃত করেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জিয়াউর রহমান জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, খুনী মোশতাকের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছিল জিয়াউর রহমান। আর তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে খুনী মোশতাক প্রথমেই জিয়াকে সেনাপ্রধান করে। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জিয়া উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড তদন্তে লন্ডনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির স্যার টমাস উইলিয়াম এমপি ভিসা নিতে গেলে তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হয়নি। জিয়া হত্যাকান্ডে জড়িত না থাকলে, বিএনপির খুনীর দল না হলে তদন্ত করতে বাধা দিল কেন? তাদের এত কি দুর্বলতা ছিল?
সামরিক ক্যুর নামে জিয়াউর রহমানের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার-সৈনিককে হত্যা করার উদাহরণ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এদেশে গুম-খুনের রাজনীতি চালু করেছিল জিয়াউর রহমান। শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা নয়, সামরিক বাহিনীতে যারা মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছিলেন তাদের নির্মমভাবে ফাঁসি দিয়ে কিংবা গুলি করে হত্যা করে এই জিয়া। অনেকেই বলেন, নাস্তার টেবিলে কাটা চামচ দিয়ে খেতে খেতে নাকি ফাঁসির হুকুমে সই করত জেনারেল জিয়া। নিরপরাধ মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে সে। তাদের কান্নায় চিৎকারে আকাশ ভারি হয়ে উঠত। আর এখন সেই বিএনপি গুম, খুনের কথা বলে!