ডেঙ্গু-রোহিঙ্গা-ধর্ষণ ॥ তিন ইস্যুতে অস্বস্তি সরকারে

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ডেঙ্গু রোহিঙ্গা ও ধর্ষণ- এই তিন ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার চরম অস্বস্তিতে পড়েছে। এসব বিষয়ে আশু সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে সরকার সর্বোচ্চ তৎপরতা চালালেও কোনো পথ খুঁজে না পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক এডিস মশার বিস্তারের আগাম বার্তা দেয়ার পরেও সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশনগুলো তা নিয়ে গা করেনি। বরং ডেঙ্গু নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পরে তা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। অথচ ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে। বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে ১৬৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সিটি কর্পোরেশন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও দায় এখন সরকারের ওপর চাপাচ্ছে। উচ্চ আদালতও প্রায় একই কথা বলছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ গত মঙ্গলবার উচ্চ আদালতে বলেন, ‘বিদেশ থেকে ওষুধ আনার দায়িত্ব সরকার নেয়নি। এরকম একটি দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব নেয়ার দরকার ছিল। তা না নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের উপর ছেড়ে দিয়েছে।’ ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নেয়া কার্যক্রমবিষয়ক শুনানিতে তিনি এসব কথা বলেন আদালতে। পাশাপাশি ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে হাইকোর্ট গত মঙ্গলবার বলেছে, ‘কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এমনটি হয়েছে। সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রী বা দলের দায়িত্বশীলরাও ডেঙ্গু বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট নন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। এ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত বুধবার তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘মৌসুমি আয়োজনে’ ডেঙ্গু রোধ করা যাবে না। অন্যদিকে মিয়ানমার রাষ্ট্রের নিপীড়ন আর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণভয়ে পালানো রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে আবার। তাদেরকে ফেরত পাঠানো যাবে কিনা, আন্তর্জাতিক মহল এ বিষয়ে কতটা আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে, সরকার কতটা কঠোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারবে তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষ করে গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয় গ্রহণের বা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সমাবেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার শোডাউন, প্রত্যাবাসনের দিন রোহিঙ্গারা উপস্থিত না থাকা, পরপর দুই দফায় এই প্রক্রিয়া ভেস্তে দেয়ায় এই বিতর্কের জন্ম হয়েছে। রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্টের সমাবেশে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে, নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ ৫ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা ফিরে যাবে না। একটি স্বাধীন দেশে আশ্রিত ব্যক্তিরা এ ধরনের শোডাউন করতে পারে কি-না বা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বিশেষ মোনাজাতের কথা বলে এতটা সুসজ্জিত অবস্থায় কি করে তারা এ সমাবেশ করেছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কিছু এনজিও এরই মধ্যে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে বলে পাওয়া অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। ওই এনজিওগুলো এই সমস্যা টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী। এর সঙ্গে বাংলাদেশ বিরোধী একাধিক রাষ্ট্র ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার কথা শোনা যাচ্ছে। এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিশ্র“ত অর্থদাতারাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। মিলছে না প্রতিশ্র“ত অর্থ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের পেছনে ব্যয় হচ্ছে। বিশাল বনভূমি তাদের আবাসের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এই রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সরকারি ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করছে। গত দুই বছরে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ৪৩ রোহিঙ্গা জীবন হারিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ৩২ রোহিঙ্গা। তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক, মানব পাচারসহ নানা অপরাধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। এর মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী সংক্রান্ত মামলা ৩১টি। এতে আসামি ১ হাজার ৮৮ রোহিঙ্গা। সর্বোপরি আশ্রিত রোহিঙ্গারা কক্সবাজার এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে ব্যাপকহারে। এমনকি তাদের কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা নানা সংকটের শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে পর্যবেক্ষকমহল মনে করছে, রোহিঙ্গা সমস্যা এখন একটি ভয়ঙ্কর দিকে মোড় নিচ্ছে। তাদের মতে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে এখনই আন্তর্জাতিক মহল পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের নিজস্ব ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক দু’ভাবেই কথা বলছেন। গত বুধবার তিনি এক বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টিকারী এনজিওগুলোর নজরদারি বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। খোদ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর সহযোগিতা চেয়েছেন একাধিকবার। এখন সে প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হচ্ছে। জানা গেছে, জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কঠোর তৎপরতা চালাবেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা খেলা চলছে। বিদেশি কিছু এনজিও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। যার মধ্যে পাকিস্তানপন্থি কয়েকটি এনজিও রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে ফেরত না যায় সে বিষয়ে দেশি-বিদেশি কিছু এনজিও ইন্ধন দিচ্ছে। সেখানে রাজনীতি হচ্ছে। এসব বিষয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে রোহিঙ্গা নেতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে, শাস্তির আওতায় আনা হবে তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ডেঙ্গু সংকটের জন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ দায়ী। তারা যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত না নিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে বাড়তে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেয়া সংকট। রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব মিয়ানমারের। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব পালন করছে না। এজন্য সরকারকে কূটনৈতিক পর্যায়ে আরও কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলকে দ্রম্নত এবং জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা সংকট ঘনীভূত হবে। এদিকে দেশে নারী এবং শিশু ধর্ষণের মাত্রাও সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় একাধিক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের কথা উঠে আসছে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের সঙ্গে প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততার কথাও জানা যায়। চলতি বছরের ৮ মাসে কয়েকশ’ নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন সংবাদে। শুধু ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, নোয়াখালীতে স্ত্রীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে মানববন্ধনে অংশ নেয়ায় অভিযুক্তরা স্বামীকে অ্যাসিড মেরেছে। চট্টগ্রামের বন্দর থানায় শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ, নেত্রকোনার পূর্বধলায় ইয়াসমিন আকতার, নারায়ণগঞ্জে গৃহবধূকে অচেতন করে ধর্ষণের পরে ও অশ্লীল ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে কয়েক লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে এক পুলিশ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় গত রোববার রাতে (২৫ আগস্ট) প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে ধর্ষণ করেছে আমিরুল মুন্সী নামে (৪০) অটো চালক। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ১৪ বছরের কিশোরী ধর্ষণ, রংপুরের স্কুল ছাত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে একদল যুবক। দিনাজপুরে ৬ বছরের শিশু ধর্ষণ, নাটোরে যৌন হযরানির অভিযোগে শিক্ষক আটক। প্রতিদিনই এরকম একাধিক ঘটনার কথা প্রকাশিত হচ্ছে। শুধু ধর্ষণই নয়, ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যার শিকারও হচ্ছে কেউ কেউ। বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক বৈঠকে আলোচনাও হয়েছে। সেসব আলোচনায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলোর দ্রম্নত তদন্ত ও দায়ীদের যথাযথ শস্তি নিশ্চিতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি সমাজ ও মানুষকে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। পরিবার থেকে নারীদের সম্মানের জায়গাটি নিশ্চিত করতে হবে। তার মতে, ধর্ষণ বন্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করা প্রয়োজন। ধর্ষণের কারণ ও এর প্রতিকার প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ধর্ষণের মূল কারণ হলো নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক হতাশা। এ জায়গা থেকে আমাদের সম্মিলিতভাবে বেরিয়ে আসা খুব প্রয়োজন। তার মতে, পুরুষের সামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে পারিবারিক শিক্ষা এবং বিজ্ঞানসম্মত যৌন শিক্ষার মাধ্যমে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব। তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে ধর্ষকদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা, শিক্ষা পাঠ্যক্রমে যৌন শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা এবং ধর্ষণবিরোধী সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচি বছরব্যাপী পরিচালনা করা।