তরল দুধ এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিক্রি কমেছে ৩৩ শতাংশ ॥ মিষ্টি ও পনিরের মান নিয়েও সন্দেহ

69

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গৃহিনী তানজুম আরা তার শিশুদের জন্য প্যাকেটজাত তরল দুধ কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে পরিচিত এক ব্যক্তির খামার থেকে বাচ্চাদের খাওয়ার জন্য দুধ সংগ্রহ করছেন তিনি। কিন্তু খামার থেকে দুধ কিনছেন সেটা কি নিরাপদ? এখন নিম্নমানের সয়াবিন তেল, দুধ তৈরির চক পাউডার, সোডা ও কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে গরুর খাঁটি দুধ। আবার কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি এই ‘খাঁটি দুধ’ দীর্ঘদিন ধরে পাস্তুরিত দুগ্ধ কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহও করে আসছেন ভেজাল দুধ তৈরিকারীরা। ফলে তরল দুধ নিয়ে সত্যিই শঙ্কায় পড়েছেন ক্রেতারা। আর এই আস্থাহীনতার প্রভাব পড়েছে প্যাকেটজাত পাস্তুরিত তরল দুধ বিক্রিতে। এক সপ্তাহের ব্যবধানেই দৈনিক দুধ বিক্রি কমেছে ৩৩ শতাংশ। তারপরও শুধরানোর পথে যাচ্ছে না তরল দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা এ্যান্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকারক পদার্থমুক্ত শতভাগ বিশুদ্ধ দুধ উৎপাদনের পরিবর্তে আগের প্রক্রিযায় উৎপাদিত পাস্তুরিত দুধই বাজারজাত করে যাচ্ছে। তারা যে কোন ল্যাবেই তাদের উৎপাদিত দুধ এ্যান্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকর পদার্থমুক্ত বলে ঘোষণা দেয়ার সৎসাহস দেখাচ্ছে না।
আবার খামার থেকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দোহানো দুধ কিনে আনছেন! এটাও কি নিরাপদ? যে গরুর দুধ আপনি নিয়ে এসেছেন সেই গরুকে কি এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়। হলে কি ২১ দিনের মধ্যে খাওয়ানো হয়েছে? এটা আপনি নিশ্চিত হবেন কিভাবে?
এসব কারণে অনেকেই বলছেন, বাজার থেকে তারা দুধ কেনা ছেড়েই দিয়েছেন। বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া কয়েকটি পাস্তুরিত তরল দুধের নমুনায় এ্যান্টিবায়োটিক ও সিসার মতো ক্ষতিকর উপাদান পাওয়ার পর ক্রেতারা দুধ নিয়ে সত্যিই শঙ্কায় পড়েছেন। অনেকে আবার শঙ্কিত দুধ দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন খাবারের মান নিয়েও।
তানজুম আরাই বলছিলেন, দুধে ক্ষতিকর উপাদান থাকার খবর পাওয়ার পর থেকে মিষ্টি বা পনিরের মতো দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ার ব্যাপারেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না তিনি। সব মিষ্টি যে খামার থেকে আনা দুধ দিয়েই বানানো হয় তার নিশ্চয়তা কী! অনেক মিষ্টিই হয়তো এরকম প্যাকেটজাত দুধ দিয়ে তৈরি করা হয়। তাই মিষ্টি, দেশীয় পনিরও যে কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সন্দেহ।
শঙ্কাটা কোথায় : সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দুধের রং, সুবাস ও সয়াবিন তেল মিশিয়ে ফ্যাট সৃষ্টির মাধ্যমে দুধ তৈরি। ভেজাল দুগ্ধ ব্যবসায়ী ও অসাধু ঘোষরা দৈনিক হাজার হাজর লিটার এসব ভেজাল তরল দুধ তৈরি করে সড়ক পথে যেমন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে আসছে, তেমিন বিভিন্ন ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারে সরবরাহ করছে। আর ওই ভেজাল দুধ প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে দেশের নামীদামী ব্র্যান্ডের নামে মোড়কীকরণ করে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানো হচ্ছে। জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে কাপড় কাঁচা ডিটারজেন্ট পাউডার, সয়াবিন তেল, সোডা, স্যালাইন, চিনি, গুঁড়া দুধসহ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে ভেজাল ও নকল দুধ তৈরি করে আকর্ষণীয় মোড়কে ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করে আসছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। আবার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়ার মোহনপুর ও ফরিদপুর থানার ডেমরা ইউনিয়নের পালপাড়া সংলগ্ন এলাকায় ভেজালকারীরা প্রথমে দুধ থেকে ক্রিম তুলে ঘি তৈরি, এরপর টানা দুধ দিয়ে ছানা তৈরি ও তারপর ছানার পানির সঙ্গে ফরমালিন, কাটিং ওয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও দুধের সুবাস তৈরির জন্য এ্যাসেন্স মিশিয়েও ভেজাল দুধ তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি করে আসছে।
প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারির অভাবে দুগ্ধসমৃদ্ধ এ জনপদের বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানির ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টার স্থাপনের পর থেকে এ অপকর্ম চলে আসছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গবাদিপশুসমৃদ্ধ পাবনা-সিরাজগঞ্জের পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ফরিদপুর, ডেমরা, ভাঙ্গুরা, চাটমোহর ও সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ, তাড়াশ এলাকাসহ বাঘাবাড়ী মিল্কশেড এরিয়া (পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর) থেকে প্রতিদিন প্রায় চার লাখ লিটার টাটকা তরল দুধ সংগৃহীত হয়। সংগৃহীত ওই দুধের একাংশ দেশের সর্ববৃহৎ সমবায়ী প্রতিষ্ঠান ‘মিল্কভিটা’য় চলে যায়। দিনে লাখ লাখ লিটার দুধ উৎপন্ন হওয়ায় শাহজাদপুরে মিল্কভিটার পাশাপাশি ব্যাঙ্গের ছাতার মতো ১৪টি বেসরকারী ডেইরি প্রজেক্টের দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আর ওই কেন্দ্রগুলো স্থাপিত হওয়ার পর থেকে ভেজালকারী ওই চক্রটি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কেমিক্যাল মিশিয়ে ভেজাল দুধ উৎপাদন করে কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করতে শুরু করে। প্রথমে এ ভেজাল দুধের ব্যাপারে ওইসব কুলিং সেন্টারের অনেক কর্মকর্তাও অজ্ঞ ছিলেন। পরে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হওয়ার পর থেকে বিপুল অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে তারাও জনস্বাস্থ্যকে জিম্মি করে ভেজাল দুধ সরবরাহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছেন।
স্থানীয় দুগ্ধ ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে লিটারপ্রতি দুধের দাম ও এক কেজি গো-খাদ্যের দামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তারতম্য না থাকায় পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার দুগ্ধসমৃদ্ধ এলাকা শাহজাদপুর, বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ফরিদপুর, ডেমরা, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, তাড়াশ ও রায়গঞ্জের তরল দুধ ব্যবসায়ীদের অনেকেই খাবার পানির সঙ্গে, ছানার পানির সঙ্গে ময়দা ও চিনি জ্বাল দিয়ে তাতে ফরমালিন, কাটিং ওয়েল, পার অক্সাইড, খাইসোডা ও দুধের ননী মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করছে। তারা প্রতি ৩৭ লিটার খাবার পানিতে ৩ লিটার দুধের ননী, ৫০ গ্রাম খাইসোডা, কয়েক চামচ পার অক্সাইড, ফরমালিন ও কাটিং ওয়েল মিশিয়ে ১ ক্যান (৪০ লিটার) নকল ভেজাল দুধ তৈরি করে। দুধ সাধারণত ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার বেশি সতেজ না থাকায় এতে ফরমালিন ও ৪০ লিটার ক্যানে ৩ থেকে ৫ লিটার পানি মেশানো হচ্ছে। এতে ৪৮ ঘণ্টায়ও তৈরিকৃত ভেজাল দুধ নষ্ট হচ্ছে না। ফলে ঢাকা, বগুড়া, টাঙ্গাইলসহ দেশের দূরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় তরল দুধ পৌঁছানোর কাজে কোন বেগ পেতে হচ্ছে না।
সম্প্রতি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ার পর এ ধরনের নকল দুধ তৈরির বিষয়ে জনসমক্ষে এসেছে। পাবন ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ এই নকল ও ভেজাল দুধ তৈরিকারীদের আটক করেছে। সঞ্চয় ঘোষ নামে এক দুধ ব্যবসায়ীকে আটক করার পর জানা যায়, নিম্নমানের সয়াবিন তেল, দুধ তৈরির চক পাউডার, সোডা ও কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হতো পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার সঞ্জয় ঘোষের ‘খাঁটি দুধ’। কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি এই ‘খাঁটি দুধ’ দীর্ঘদিন ধরে মিল্ক ভিটার বিভিন্ন দুগ্ধ ব্যবস্থাপনা সমিতির কাছে সরবরাহ করে আসছিল সঞ্জয় ঘোষ। ভাঙ্গুড়া উপজেলার ছোট বিশাকোল গ্রামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে গরুর নকল দুধ তৈরির কারখানা গড়ে তোলেছিল সঞ্চয় ঘোষ। ওই গ্রাম থেকেই নকল দুধ তৈরির সরঞ্জামসহ সঞ্জয় ঘোষ নামের ওই দুধ ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। পরে তাঁকে এক বছরের কারাদ-াদেশ দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল দুধ পান করে শিশুসহ আমজনতার কিডনি, লিভারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ রফিকুল ইসলাম জানান, রাসায়নিক মিশ্রিত এসব ভেজাল দুধ মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পেট ব্যথা ও ডায়রিয়ার পাশাপাশি ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানোর কারণে এসব দুধ খেয়ে কিডনি ও লিভার বিকল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাজারে প্রভাব : দুধে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের কয়েকটি ব্র্যান্ডের দুধের বিক্রি যে কিছুটা কমেছে তা বাজারে গিয়েও বোঝা যায়। যদিও খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া গেছে। পাস্তুরিত তরল দুধের বিক্রির হার স্বাভাবিক আছে বলে কেউ কেউ দাবি করলেও অনেকেই স্বীকার করেন যে দুই তিন সপ্তাহ আগের তুলনায় বিক্রি কিছুটা কমেছে। তবে তরল দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে মানুষের আস্থা যে কমেছে, সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের তথ্য থেকেই তার প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের তথ্য থেকে দেখা যায়, দেশে পাস্তুরিত তরল দুধের ৭০ শতাংশই বিপণন করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় চার প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা, আড়ং, প্রাণ ডেইরি ও আকিজ ফুড এ্যান্ড বেভারেজ। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন গড়ে ৪ লাখ ২৫ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করেছে। চলতি জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে তা ২ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ লিটারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে দৈনিক দুধ বিক্রি কমেছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ লিটার বা ৩৩ শতাংশ। তৃতীয় সপ্তাহে তাদের দুধ বিক্রির পরিমাণ আরও কমেছে বলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
পাশাপাশি দেশের ১৫টি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দৈনিক প্রায় দুই লাখ খামারির কাছ থেকে ৫ লাখ লিটার দুধ ক্রয় করত। বর্তমানে তা দুই লাখ ৭৯ হাজার লিটারে নেমে এসেছে। এসব তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয়, দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়েছেন ক্রেতারা। এখন প্রশ্ন হলো সহজে বি আর এই হারানো আস্থা ফেরাতে পারবেন ক্রেতারা? আদালতের হস্তক্ষেপে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পর দুধের মান হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু সহজে কী আর ওই ব্র্যান্ডগুলোর ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবেন তারা? প্রয়োজনে হয়তো পরিবারের সদস্যদের দুধ খাওয়ার পরিমাণই কমিয়ে দেবেন।
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ মানুষ বাজারের দুধের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেললে তা দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির জন্য আশঙ্কাজনক হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে, অপুষ্টির হার ব্যাপক। এরকম পরিস্থিতিতে দুধের মত পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারের ওপর যদি মানুষ আস্থা হারায়, তা ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় হয়ে দেখা দিতে পারে।