সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি ॥ লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী ॥ ত্রাণের জন্য হাহাকার

139
গোয়াইনঘাটে পানিতে তলিয়ে যাওয়া একটি রাস্তা।

আল-হেলাল সুনামগঞ্জ থেকে  :
ছয় দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জ জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার ৬ উপজেলার প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্টে শনিবার পানি বিপদ সীমার ৮৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীলরা। উপজেলাগুলোর ৫০ টি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৯৫ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ঈাহাড়ী ঢল ও টানা বৃষ্টিতে জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, জামালগঞ্জ, ছাতক ও সুনামগঞ্জ সদরের নিম্নাঞ্চলের মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চল সুরমা নদীর পানি কুলে উপচে পৌর শহরের কাজির পয়েন্টে, নবীনগর, জামতলা,উত্তর আরপিন নগর, উকিলপাড়া, সুলতানপুর,উত্তর আরপিননগর, তেঘরিয়া সহ কয়েকটি এলাকা দিয়ে ঢুকে শহর এবং শহরতলিতেও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সড়কের আনোয়ারপুর, শক্তিয়ারখলা, লালপুর, চালবন্ধ এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে পানি ওঠেছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর, সুরমা, ভোগলা, বাংলাবাজার, নরসিংহপুর এবং দোয়ারা সদর ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। দোয়ারাবাজার-ছাতক উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কের বিভিন্ন স্থান ডুবে যাওয়ায় এই সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সড়কের মাঝেরগাঁও, মংলারগাঁও ও নৈনগাঁও এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি।
জামালগঞ্জ উপজেলা সদরের সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এই উপজেলার সুনামগঞ্জ-সাচনা সড়কের নিয়ামতপুর, ইচ্ছারচর, বেরাজালী, সেলমস্তপুর ও কলাইয়া অংশে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। এই উপজেলার আরেক সড়ক সুনামগঞ্জ-জয়নগর-জামালগঞ্জ সড়কের জয়নগর পার্শ্ববর্তী অংশে এবং ধনপুর অংশে পানি ওঠেছে।
এদিকে- পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে জেলার ৩ উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে।
গৌরারং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান মো. ফুল মিয়া বলেন, আমার এলাকার অবস্থা খুবই খারাপ। মানুষকে দেখতে গেলে কিছুই দিতে পারি না। মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে।
জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ফরিদুল হক বলেন, বরাদ্দ দেওয়া চাল ও শুকনো খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে। আমাদের হাতে দুইশত মেট্রিক টন জিআর চাল রয়েছে। সেটি আমরা সব গুলো উপজেলার ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের বরাবরে প্রেরণ করব। এবং আমরা ইতি মধ্যে ২০ লক্ষ টাকা ৫০০ মেট্রিক টন চালের জন্য চাহিদা পত্র প্রেরণ করেছি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে।
জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারন সম্পাদক এডভোকেট পীর মতিউর রহমান বলেন, আমরা জেলার সকল উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করেছি। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও প্রস্তুতি রয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর : বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নে বন্যা দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।
শনিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৬২০ পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার প্যাকেট ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো.শরিফুল ইসলাম।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সফর আলী, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সমীর বিশ্বাস, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিনা আক্তার, সুলোকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রওশন আলী, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্দুল কাদির, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি সফর আলী, জাপা নেতা হিফজুর রহমান, বাদল মিয়া, ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান, মনোয়ারা বেগম প্রমুখ।
ত্রাণ বিতরণ শেষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, আজকে আমরা বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সুলেকাবাদ ইউনিয়নের ৬২০টি পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে শুকনো খাবার বিতরণ করেছি এবং পাশাপাশি বিতরণের জন্য ইতোমধ্যে এ ইউনিয়নে জিআর চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।আমাদের প্রত্যেকটি উপজেলার নিবার্হী কর্মকর্তারা বন্যা দুর্গত মানুষের পাশে আছে এবং তাদের সব ধরনের সহযোগিতার জন্য তারা অব্যাহত আছে।
কে. এম. লিমন গোয়াইনঘাট থেকে জানিয়েছেন : গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ঠ বন্যার পর গোয়াইনঘাটের নিম্নাঞ্চল গুলোতে কমতে শুরু করেছে পানি। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ডলের কারনে সৃষ্ট বণ্যার পানি কমতে শুরু করলেও এখনো পানি বন্দি রয়েছেন উপজেলার অধিকাংশ মানুষ। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাড়ছে পানি বাহিত নানা রোগ বালাই, ভাঙ্গছে সড়ক পথ। উপজেলা সর্বত্রই চলছে ত্রাণ বিতরণ। গতকাল শনিবার উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে পাহাড়ি ঢলের কারণে গোয়াইনঘাটের পিয়াইন ও সারী নদীর পানি গত কয়েক দিনের তুলনায় অনেকটা কমতে শুরু করেছে। উপজেলার সব ক’টি ইউনিয়নেই পানি কমে গিয়ে অধিকাংশ মানুষ পানি বন্দি থেকে মুক্ত হওয়ার পথে থাকলেও এখনো বণ্যা আতঙ্কে রয়েছেন মানুষ।
গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত উপজেলার পূর্ব জাফলং, পশ্চিম জাফলং, আলীরগাঁও, রুস্তমপুর, ডৌবাড়ি, লেঙ্গুড়া, তোয়াকুল ও নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামে খবর নিয়ে জানাযায় সর্বত্তই রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর বন্যায় প্লাবিত পানি কমতে শুরু করেছে। এতে করে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট গুলোতেও পানি কমার কারনে যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে। তবে পানি কমার কারণে চোখে পড়ছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক গুলো। দেখা গেছে একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক। সড়কগুলো দ্রুত সংস্কার করার দাবী এলাকাবাসীর। বন্যার পানি কমলেও এখনো উপজেলার বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারনে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। পানি কমলেও বাড়ছে পানি বাহিত নানা রোগ বালাই। উপজেলার সিংহভাগ এলাকায় নেই বিদ্যুৎ। উপজেলার প্রায় ৮০ ভাগ জমির আউশ, আমন ধান ও বীজ তলা এখনো রয়েছে পানির নিচে।
বন্যার কারণে দেশের অন্যতম বৃহৎ দুটি পাথর কোয়ারি জাফলং ও বিছনাকান্দি বন্ধ হয়ে পড়ায় প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
অপর দিকে একাধারে মুশলধারে বৃষ্টি হওয়ায় উপজেলার প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি রয়েছেন। দুই লক্ষাধিক বন্যার্ত মানুষের খোঁজ, খবর ও ত্রাণ সহায়তা প্রদানে জন প্রতিনিধিদের পাশাপাশি বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে উপজেলার সবকয়টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, গোয়াইনঘাটে কর্মরত সংবাদকর্মী, বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ছাড়াও ভান বাসী মানুষের সাথে মোবাইলে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখে চলেছেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ^জিত কুমার পাল গোয়াইনঘাটের বানবাসী মানুষের উদ্দেশ্যে বলেছেন- বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে আতংকিত না হয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে মোকাবেলা করার জন্য। তিনি জানিয়েছেন সরকারের পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। কোন মানুষ এক বেলাও না খেয়ে থাকবেনা। উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন ও উপজেলা সদরে অবস্থিত সকল বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রগুলি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাণ বাসী মানুষের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানানো হয়েছে। গত দুই দিন থেকে তিনি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোতে বাণ বাসী মানুষের বিশুদ্ধ জল ও খাবারের ব্যবস্থার পাশাপাশি একটু শুকনো খাবার পৌঁছাতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয়দের সহায়তায় তহবিল গঠন করা হয়েছে। উপজেলার সর্বত্তই গত দু-দিন বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাটের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মোছাঃ আফিয়া বেগম জানান উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক দিক মনিটরিং করা হচ্ছে। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও বন্যা কবলিত এলাকার ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে প্রয়োজনীয় আরও ত্রাণ সামগ্রীর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বুধধবার থেকে পিয়াইন নদিতে ডুবে নিখোঁজ যুবকের কোন সন্ধান পওয়া যায়নি।
মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে।
এদিকে কমলগঞ্জ উপজেলার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের রামপাশা এলাকায় ধলাই নদীর একটি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে রামপাশা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে পানি কমতে শুরু করেছে।
শনিবার (১৩ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মনুর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ধলাইর পানি বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে শুক্রবার (১২ জুলাই) মধ্যেরাত থেকে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। তবে সকাল থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী শনিবার দুপুরে বলেন, ‘টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। তবে পানি নামতে শুরু করেছে। বন্যা মোকাবেলায় আমাদের সব ধরেণর প্রস্তুতি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কমলগঞ্জের রামপাশা এলাকায় ধলাই নদীর বাঁধ ২০ ফুট জায়গা জুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ওই গ্রামের আংশিক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমরা ভাঙন এলাকায় রয়েছি।’
কানাইঘাট থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন : টানা ভারী বর্ষণ ও গত দু’দিন থেকে উজান থেকে নেমে আসা তীব্র পাহাড়ী ঢলের কারণে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। শুক্রবার রাতে কানাইঘাট সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ১১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাটে বিপদ সীমার ১৫৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বন্যা দুর্গতদের জন্য এখন পর্যন্ত ৪টন চাল সরকারিভাবে বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। সুরমা,লোভা সহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি হু হু করে বেড়ে যাওয়ার কারণে একদিকে নদী ভাঙ্গণ তীব্র আকার ধারণ করেছে। অপরদিকে প্রবল পানির স্রোতের কারণে গোটা উপজেলার বিস্তৃীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়,ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের কারণে কানাইঘাট বাজারে হাঁটু সমান পানি বিরাজ করছে। অনেক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বানের পানিতে আক্রান্ত হয়েছে। কানাইঘাট-চতুল সড়কের নিচু এলাকা দিয়ে বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি সড়কের বিকল্প নকলা বেইলি ব্রীজ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে সিলেটের সাথে কানাইঘাট উপজেলা সদরের সাথে সব ধরনের ভারী যানবাহন চলাচল শনিবার সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও কানাইঘাট-সুরইঘাট সড়কের বিভিন্ন অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে এবং সড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙ্গণ দেখা দিয়েছে। উপজেলার ৯ টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিস্তৃীর্ণ ফসলের মাঠ বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় শত শত বিঘা আউশ ধানের জমি ও আমন ধানের বীজতলা তলিয়ে গেছে। ফলে কৃষকদের মধ্যে উৎকন্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়েছে। কয়েকশ বাড়ি ঘরে শুক্রবার রাত থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। যার কারণে এসব বসত বাড়ির লোকজন অনেকে বিভিন্ন স্থানে ও সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছেন। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ২নং লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউপির চেয়ারম্যান জেমস লিও ফারগুসন নানকা জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নের সব নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীপ্রসাদ দক্ষিণ, লক্ষ্মীপ্রসাদ উত্তর, কুকুবাড়ি, কুওড়ঘড়ি, গরিপুরের একাংশ, নিহালপুর, হালাবাদি, আগফৌদ, কালিনগর, বড়বন্দ, গোরকপুর, সোনাতন পুঞ্জি, বাউরবাঘ ১ম, ২য়, ৩য় খন্ড ও বারোফনী গ্রামের অধিকাংশ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রায় দেড় শতাধিক বাড়ি ঘর বানের পানিতে আক্রান্ত হয়েছে। রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাটে ভাঙ্গণের পাশাপাশি কয়েকশ বাড়িঘরের মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। তাদের বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। বেশিরভাগ আউশ ধানের ফসলী মাঠ তলিয়ে গেছে। নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির চেয়ারম্যান ডা: ফয়েজ আহমদ জানান,তার ইউনিয়নে লোভা ও সুরমা নদীর তীব্র ভাঙ্গণের পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। মেছা, ছত্রিপুর, বাজেখেল, কান্দলা, ভাল্লুকমারা খালাইয়ুরা, উজান ভারাফৈত, নক্তিপাড়া, ছোটফৌদ, নারাইনপুর, কাড়াবাল্লা পূর্ব-পশ্চিম, কেউটি হাওর এবং কান্দিগ্রামের অধিকাংশ এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। অনেক বাড়িঘর পানিতে আক্রান্ত। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে মেছা সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন। এছাড়া বড়চতুল ইউনিয়ন,দিঘীরপাড় পূর্ব,সাঁতবাক,কানাইঘাট সদর,বাণীগ্রাম,ঝিংগাবাড়ি ইউনিয়ন ও কানাইঘাট পৌরসভার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেকের বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া সুলতানা ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বন্যা পরিস্থিতি দেখেন এবং বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক বিষয় তদারকি করছেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শীর্ষেন্দু পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, কানাইঘাটের বন্যা পরিস্থিতির প্রতিনিয়ত সংবাদ জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করা হচ্ছে। আমরা সার্বক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি মনিটরিং করে যাচ্ছি। সরকারিভাবে শনিবার বন্যা দূর্গতদের জন্য ৪টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং তা আজই বিতরণ করা হবে। এদিকে কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুমিন চৌধুরী বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করে জরুরী ভিত্তিতে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ এবং সুরমা ডাইক ভেঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির যাতে আরো অবনতি না ঘটে, এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সজাগ থাকার দাবি জানিয়েছেন।
মো. শাহজাহান মিয়া জগন্নাথপুর থেকে জানিয়েছেন : জগন্নাথপুরে টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। কুশিয়ারা ও নলজুর সহ বিভিন্ন নদ-নদী ও হাওরে বেড়ে চলেছে পানি। বন্যার পানিতে উপজেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েকটি গ্রাম প্রায় তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন হাট বাজারে ও বাড়িঘরে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে অনেক রাস্তাঘাট। যে কারণে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
১৩ জুলাই শনিবার সরজমিনে পৌর এলাকা ও উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ সময় স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক দিন ধরে জগন্নাথপুরে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেই সাথে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে কুশিয়ারা নদী উপচে উঠে নদী পাড়ের হাট বাজার, গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন বাড়িঘরে পানি উঠেছে। এর মধ্যে রাণীগঞ্জ, বড়ফেছি, স্বাধীন বাজার, পাটকুড়া বাজার সহ বিভিন্ন বাজারে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। এতে অনেক স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলার রাণীনগর সহ কয়েকটি গ্রাম প্রায় তলিয়ে গেছে। এছাড়া উপজেলার অধিকাংশ নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। এতে অনাকাক্সিক্ষত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগী জনতা। যদিও পানিবন্ধি লোকদের মধ্যে অনেকে উচুঁ এলাকার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকে আবার নিজ ঘরে বাঁশের মাচা বানিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। তবে গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
কোম্পানীগঞ্জ থেকে জানিয়েছেন : কোম্পানীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। টানা এক সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকালের চেয়ে শনিবার একফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ধলাই ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার্ত মানুষজন চরম দুভোর্গ পোহাচ্ছে।
গো খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। লোকজনের চলাচলের এক মাধ্যম নৌকা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী জানান, বন্যা মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে। লোকজনকে আতংকিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।
ছয়টি ইউনিয়নের বন্যার্ত লোকজনের মাঝে ত্রাণ বিতরণের জন্য আট টন চাল বরাদ্ধ করা হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসনের উদ্যাগে ত্রাণ বিতরণ : কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বন্যা দুর্গত বিভিন্ন এলাকায় বন্যার্তদের মাঝে উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ বিতরণ করা হয়। শনিবার দুপুরে পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের শিমুলতলা আশ্রয়ণ প্রক্লপের দুইশত পরিবারের মধ্যে পাঁচ কেজি চাল, বিশুদ্ধ পানিসহ শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম)মো. আবুল কালাম জেলা প্রশাসনের পক্ষে ত্রাণ বিতরণ করেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী, ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, সহকারি কমিশনার (ভূমি) অনুপমা দাস, ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম, প্রেসক্লাব সভাপতি আবুল হোসেন, সমাজ সেবা কর্মকর্তা বিশ্বপতি চক্রবর্তী, প্রকল্প অফিসার বিদ্যুৎ কান্তি দাস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী রতন লাল সাহা, উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক গোলাম রহমান, বাংলানিউজের রিপোর্টার মেহেদী নূর পরশ, উত্তর পূর্ব প্রতিনিধি কবির আহমদ, সাইফুর রহমান কলেজের প্রভাষক আমজদ আলী, ইউপি সদস্য নাজমা খাতুন ও আব্দুর রউফ প্রমুখ।
পিন্টু দেবনাথ কমলগঞ্জ থেকে জানিয়েছেন : কমলগঞ্জের ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের পৌর এলাকার রামপাশায় ভাঙন দিয়েছে। টানা বর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শুক্রবার (১২ জুলাই) দিবাগত রাত ১টার দিকে ভাঙ্গন দেখা দেয়।
প্রবল গ্রোতে বানের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় বাঁধ সংলগ্ন পাঁচটি বাড়ী ভেঙ্গে যায়। বাড়ীর লোকজন পার্শ্ববর্তী লোকজনের সহায়তায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কমলগঞ্জ পৌর এলাকার রামপাশাসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।গ্রামের রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পানিতে নিমজ্জিত হওয়াসহ ভেসে গেছে পুকুর ও ফিসারীর কয়েক লাখ মাছ।এতে পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের কয়েক হাজার মানুষ। ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করেছেন মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশেকুল হক, কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ মো. আরিফুর রহমান, কাউন্সিলর রাসেল মতলিব তরফদার, আনোয়ার হোসেন সহ উপজেলা কৃষি বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা বৃন্দ এবং কমলগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের একটি দল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান জানান, প্রাথমিক ভাবে প্রায় একশত পঁচিশ হেক্টর ফসলি জমি ও আমনের বিচতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশেকুল হক জানান, বন্যায় কবলিত মানুষের জন্য শুকনা খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর নির্মাণে সহায়তা করা হবে, পানি নেমে গেলে দ্রুততম সময়ে ভাঙ্গন এলাকা মেরামত করা হবে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধসহ ভাঙ্গনকৃত বাঁধ মেরামতে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে, পানি নেমে গেলেই দ্রুত কাজ শুরু হবে।