ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড শিরোপা লড়াই আজ

39

ক্রীড়াঙ্গ রিপোর্ট :
আইরিশ থেকে ইংলিশ বনে যাওয়া ইয়ন মরগান, না ক্রিকেটে ভদ্রতার প্রতিমূর্ত কেন উইলিয়ামসন? কে হাসবেন শেষ হাসি? কার হাতে উঠবে ১২তম ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা? ধুরন্ধর জেসন রয়, ক্ল্যাসিক্যাল জো রুট, খ্যাপাটে বেন স্টোকস, সেনসেশনাল জোফরা আরচার, না আধুনিক পেস বোলিংয়ের ত্রাস ট্রেন্ট বোল্ট, নাকি নীরবে সার্ভিস দিয়ে যাওয়া অলরাউন্ডার জিমি নিশাম, চূড়ান্ত মঞ্চে জ্বলে উঠবেন কে? ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে আট ঘণ্টার ব্যাট-বলের যুদ্ধে তারই ফয়সালা আজ। যিনিই হাসুন আর যেই জ্বলে উঠুন ২৩ বছর পর ক্রিকেট যে নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পেতে যাচ্ছে সেটি তো সেমিতেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। যখন অঘোষিত মোড়ল ভারতকে নিউজিল্যান্ড এবং ‘ডিফেন্ডিং’ চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে শিরোপার নিঃশ্বাসসম দূরত্বে কুলিন ইংলিশ এবং ভাগ্যের সহায়তা পাওয়া ব্ল্যাক-ক্যাপসরা। ইংল্যান্ডের প্রাণকেন্দ্র লন্ডনের ঐতিহাসিক লর্ডসে খেলা শুরু বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে তিনটায়।
লর্ডসের গ্র্যান্ড ফাইনালে ‘প্রথম’Ñ এর মাঝেই লুকিয়ে যত মজা। কে ভেবেছিল এমন দুটি দল ফাইনালে খেলবে যারা আগে কখনও শিরোপার স্বাদ পায়নি। ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে লীগপর্ব থেকে বাদ পড়ার পর বদলে যাওয়া ইংল্যান্ড আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকায় ঘরের মাটিতে ফেবারিট হিসেবেই ফাইনালে এসেছে। যদিও তাদের যাত্রাপথটা মসৃণ ছিল না। শঙ্কা কাটিয়ে শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায় মরাগানবাহিনী। আসরের সেরা ম্যাচটা তারা দেখায় সেমিতে। যেখানে প্রতিপক্ষ পাঁচবারের শিরোপাধারী অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় সেমিতে ৮ উইকেটের বিশাল জয়ের পথে ‘ডিফেন্ডিং’ চ্যাম্পিয়নদের কার্যত উড়িয়ে দিয়ে ২৭ বছর পর ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংলিশরা। এর আগে সর্বশেষ ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের কাছে হারে যাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের এবার টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠে আসে অনেকটাই নাটকীয়তা আর ভাগ্যের ওপর ভর করে। বিশেষ করে লীগপর্বে পাকিস্তানের সমান ১১ পয়েন্ট নিয়েও নেট রানরেটে এগিয়ে থাকায় সেমির টিকেট পায় কেন উইলিয়ামসনের দল।
সেখানে হট ফেবারিট ভারতের বিপক্ষে সম্ভবত নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ম্যাচটা উপহার দেয় কিউইরা। ওল্ডট্র্যাফোর্ডে মাত্র ২৩৯ রানের পুঁজি নিয়েও ১৮ রানের দারুণ জয়ে উঠে আসে স্বপ্নের ফাইনালে। টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং বেছে নেন উইলিয়ামসন। ৪৬ দশমিক ১ ওভারে ৫ উইকেটে ২১১ রান তুলে চাপে ছিল নিউজিল্যান্ড। এরপর বৃষ্টির কারণে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। রিজার্ভ’ডেতে গড়ায় ম্যাচ। দ্বিতীয় দিন ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৩৯ রানের বেশি করতে পারেনি কিউইরা। জবাবে ব্যাট হাতে নেমে মহাবিপদে পড়ে ভারত। ৫ রানে ৩ উইকেট, ৯২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। এতে ম্যাচ জয় সময়ের ব্যাপার ছিল নিউজিল্যান্ডের। কিন্তু রবীন্দ্র জাদেজা ও মহেন্দ্র সিং ধোনির ব্যাটিং দৃঢ়তায় লড়াইয়ে ফেরে ভারত। কিন্তু শেষদিকে জাদেজা ৫৯ বলে ৭৭ ও ধোনি ৭২ বলে ৫০ রান করে ফিরে গেলে জয়ের স্বাদ পায় নিউজিল্যান্ড। আর দ্বিতীয় সেমিতে বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং বেছে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
শুরু থেকেই ইংল্যান্ড বোলারদের তোপে পড়ে অসিরা। ১৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। শুরুর ধাক্কাটা পরবর্তীতে সামাল দিলেও শেষ পর্যন্ত ৪৯ ওভারে ২২৩ রানে গুটিয়ে যায় অসিরা। অস্ট্রেলিয়ার ২২৪ রানের টার্গেট স্পর্শ করতে হিমশিম খেতে হয়নি ইংল্যান্ডকে। ওপেনার জেসন রয়ের ৬৫ বলে ৮৫ রান ইংলিশদের জয় সহজ করে। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াইয়ের টিকেট পায় ইংল্যান্ড। তার আগে উদ্বোধনী ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে উড়িয়ে দিয়ে লীগপর্বে মরগানদের শুরুটা ছিল ফেভারিটের মতোই। যদিও পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কার কাছ হারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল তারা। পরবর্তীতে ভারত এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দুটি বড় দলকে হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ইংলিশরা। চেস্টার লি স্ট্রিটে জনি বেয়ারস্টোর (৯৯ বলে ১০৬) দারুণ সেঞ্চুরির সৌজন্যে ৮ উইকেটে ৩০৫ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়া মরগানরা ফাইনালের প্রতিপক্ষ কিউইদের সেদিন ১৮৬ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে তুলে নিয়েছিল ১১৯ রানের বড় জয়। ৬ জয়ে ১২ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় দল হিসেবে সেমিতে উঠে আসে। সেখানে অসিদের গুঁড়িয়ে দিয়ে আজকের স্বপ্নের ফাইনালে কুলিন ইংল্যান্ড।
১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল হয়েছিল এই লর্ডসেই। সেবার সেমিতে চিরশত্রু অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল আয়োজক ইংলিশদের। মাঝে তিনবার ফাইনালে উঠেও শিরোপা ছোঁয়া হয়নিÑ পরেরবার অর্থাৎ ১৯৭৯তে এই লর্ডসেই হারতে হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। ইংল্যান্ড সর্বশেষ ফাইনালে উঠেছিল ২৭ বছর আগে, ১৯৯২ সালে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে। সেবার হারতে হয়েছিল ‘আন্ডারডগ’ পাকিস্তানের কাছে। পরিস্থিতির বিচারে প্রতিপক্ষ হিসেবে কিউইরাও কিন্তু আজ ‘আন্ডারডগ’। ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে নিশ্চয়ই এবার তারা কোন ভুল করতে চাইবে না। প্রায় দুইযুগ পর নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পেতে যাচ্ছে ক্রিকেটবিশ্ব। ১৯৯৬ বিশ্বকাপেই সর্বশেষ নতুন কোন চ্যাম্পিয়ন পেয়েছিল ক্রিকেট। সবাইকে চমকে দিয়ে শ্রীলঙ্কা শিরোপা নিয়ে উৎসব করেছিল। এরপর আর নতুন কোন চ্যাম্পিয়ন পাওয়ার সম্ভাবনাই জাগেনি। প্রতিবারই ফাইনাল খেলছিল অন্তত একবার হলেও বিশ্বকাপ ক্রিকেট জেতা দলগুলো। নতুন কোন দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ এসেছিল ২০১৫ বিশ্বকাপে।
কিন্তু গতবার ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হেসে খেলে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। যারা পাঁচটি শিরোপা (১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭, ২০১৫) জিতে বিশ্বকাপে সবচেয়ে সফল দল। ভারত (১৯৮৩, ২০১১) জিতেছে দুটি বিশ্বকাপ। এবার নিউজিল্যান্ডের কাছে প্রথম সেমিফাইনালে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে বিরাট কোহলির দল।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া তো পাত্তাই পায়নি। ফল ঃ ২০১৯ বিশ্বকাপ বরণ করে নিচ্ছে নতুন চ্যাম্পিয়ন। এ নিয়ে মোট পাঁচবার বিশ্বকাপ আয়োজন করল ইংল্যান্ড (১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৩, ১৯৯৯ ও ২০১৯)। এর আগে তিনবার ফাইনালে (১৯৭৯, ১৯৮৭ ও ১৯৯২) উঠলেও কখনও শিরোপার উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে পারেনি ক্রিকেটের জন্মভূমি। অন্যদিকে গতবারের (২০১৫) আগে পর্যন্ত ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৯২, ১৯৯৯, ২০০৭ ও ২০১১ পাঁচবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেও সেই বাধা টপকাতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। সেখানে গতবারের পর এবার- টানা দ্বিতীয় ফাইনাল খেলা দলটির জন্য এটি সুবর্ণ সুযোগ। ফাইনালে ফেবারিট না হওয়ায় ইংলিশদের তুলনায় কিছুটা চাপমুক্ত হয়ে খেলতে পারবে উইলিয়ামসনের দল।
লর্ডসের উইকেট সবসময়ই পেসবান্ধব। তার ওপর ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ঐতিহ্যগতভাবে সিমিং কন্ডিশনে অভ্যস্ত। সুতরাং লড়াইটা জমে উঠতে পারে। ট্রেন্ট বোল্ট, লোকি ফুর্গুসন, ম্যাট হেনরিদের মোকাবেলায় জেসন রয়, জনি বেয়ারস্টো, জো রুট, ইয়ন মরগান, জস বাটলার, বেন স্টোকসদের নিয়ে আয়োজকদের ব্যাটিং অত্যন্ত শক্তিশালী।
সেই তুলনায় নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং বলতে গেলে অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন আর সাবেক অধিনায়ক রস টেইলরের ওপর নির্ভরশীল। বড় মঞ্চে ভাল করতে হলে আজ মার্টিন গাপটিল, হেনরি নিকোলস, টম লাথামদেরও জ্বলে উঠতে হবে। জোফরা আরচার, ক্রিস ওকস, মার্ক উড, মঈন আলী, আদিল রশীদদের নিয়ে গড়া বৈচিত্র্যময় ইংলিশ বোলিংয়ের বিপক্ষে তারা কেমন করেন তার ওপর কিউইদের অনেক কিছু নির্ভর করবে। ১৯৭৩ থেকে এ পর্যন্ত মুখোমুখি ৯০ ওয়ানডের ৪৩টিতে জিতে এগিয়ে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের জয় ৪১।
টাই ২। পরিত্যক্ত ৪। সার্বিকভাবে বিশ্বকাপের পরিসংখ্যানেও এগিয়ে কিউইরা।
৪৪ বছরের বিশ্বকাপের ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৯ দেখায় ৫ জয় তাদের। ইংল্যান্ডের জয় ৪টি। ওয়েলিংটনে গতবার (২০১৫) ইংলিশদের মাত্র ১২৩ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৮ উইকেটের বড় জয় পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড। তবে এবার চেস্টার লি স্ট্রিটে লীগপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই প্রতিশোধ নেয়া মরগানবাহিনীকে লর্ডসের ফাইনালে আজ বাড়তি আত্মবিশ্বাস যোগাবে।