ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর গ্রাম

28

হোসেন তাওফিক চৌধুরী

সৈয়দপুর একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। হযরত শাহজালাল (রহ.) সঙ্গীয় ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম আউলিয়া হযরত শামসুদ্দিন (রহ.) এর স্মৃতি বিজড়িত এই গ্রাম। শতাব্দী প্রাচীন সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানাধীন এই গ্রামটি অত্র এলাকায় মুসলিম কৃষ্টি-সংস্কৃতির পাদপীঠ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
রচনার শুরুতেই ফিরে যেতে চাই ১৯২০, ১৯২১ এবং ১৯২২ সালের ইতিহাসে। ঐ সময়ে সারা ভারত উপমহাদেশে খেলাফত অসহযোগ আন্দোলনে প্রকম্পিত হয়। এই আন্দোলনে আমার পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন। সৈয়দপুরের কৃতী সন্তান মাওলানা সৈয়দ জমিলুল হক সেই অগ্নিঝরা দিনে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি সুনামগঞ্জ খেলাফত কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কারাভোগ করেন। কারাগার থেকে মুক্ত হবার পর তিনি জেলী মওলানা বলে খ্যাত হন।
আমার পিতা সাংবাদিক রাজনীতিবিদ মকবুল হোসেন চৌধুরী ১৯৫৭ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘সিলেট পত্রিকার’ সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন সৈয়দপুরের ওসমান আলী সারং। সৈয়দপুরের হাফিজ সৈয়দ আলকাব আলী সুনামগঞ্জ কোর্ট (পুরাতন) জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। তিনি একজন দরবেশতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন তার কাছেই আমাদের ইসলামী শিক্ষার গোড়াপত্তন। আমার পিতার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর। সৈয়দপুরের এই তিন ব্যক্তিত্ব সৈয়দ জামিলুল হক, ওসমান আলী সারং এবং সৈয়দ আলকাব আলী সাহেবকে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। আজ অত্যন্ত বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের স্মরণ করছি। বিচার বিভাগের জজ সৈয়দ আওলাদ হোসেন আমার চাচা অবসর প্রাপ্ত জেলা জজ ইকবাল হোসেন চৌধুরীর সাথে চাকুরি করেছেন।
সৈয়দপুরের অনেক সন্তান আমার সতীর্থ ছিলেন। তাঁদের স্মৃতিকথা আমি ভুলিনি। তাদের মধ্যে সৈয়দ মুরছালিন আহমদ, সৈয়দ আমিরুল ইসলাম (ফখরুল), সৈয়দ আব্দুল মুক্তাদির, সৈয়দ আব্দুস সালাম। আমরা সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী হাইস্কুলে এক সাথে পড়েছি। সুনামগঞ্জ কলেজে একসাথে পড়েছি আব্দুল মতিন ও সৈয়দা সুরাইয়া খাতুনের সাথে। সৈয়দ আনছাফ, নজমুল চৌধুরী ও সৈয়দ দবির আহমদ আমার অনুজ সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের সতীর্থ। আমি আইন পেশায় যোগ দেওয়ার আগে ঢাকার অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার ছিলাম। তখন সৈয়দপুরের সৈয়দ শাহদাত হোসেন ‘দৈনিক আজাদ’ এর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতার ফাঁকে ফাঁকে প্রায় ১০ খানা বই লিখে তিনি যশস্বী হয়েছেন। আইন পেশায় সুনামগঞ্জ আদালতে যোগ দেওয়ার পর এডভোকেট সৈয়দ কবীর আহমদ, সৈয়দ আকিকুল হক, সৈয়দ শায়েক আহমদ, সৈয়দ শামসুল ইসলাম, সৈয়দ সাদেকুজ্জামান, সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম প্রত্যেকের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হই। সৈয়দ জামিলুল হক সাহেবের পুত্র সৈয়দ আশরাফুল হক আকীক দিরাইয়ের এর মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রার ছিলেন। তিনি একজন লেখক ছিলেন। তাঁর পুত্র সৈয়দ ফাওয়াদুল জায়েদও আইন পেশায় যোগদান করেছেন। এর আগে তিনি দিরাইয়ের কাজী ছিলেন। ভগ্নিপতি মল্লিক মঈন উদ্দিনের (সোহেল) সাথে তিনি আইন ব্যবসা চালিয়েছেন। সৈয়দ কবির আহমদ, সৈয়দ শায়েক আহমদ ও সৈয়দ শামসুল ইসলাম সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। সৈয়দ শায়েক আহমদ জগন্নাথপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এবং ‘জগন্নাথপুর বার্তা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর ভাই সৈয়দ লোকমান আহমদ একজন যুগ্মসচিব।
সৈয়দপুরের সৈয়দ আওছাফ হোসেন ও সৈয়দ শামসুল আলম সুনামগঞ্জে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সৈয়দ আওছাফ হোসেনের পুত্র ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ জুনেদ আহমদ, সৈয়দ দবির আহমদ, সৈয়দ শফিক আহমদ ও সৈয়দ সেলিম। সৈয়দ শফিক অত্যন্ত কম বয়সে ইন্তেকাল করেন।
আগেই বলেছি তাঁদের বোন সৈয়দা সুরাইয়া খাতুন আমাদের সাথে কলেজে পড়েছেন। সৈয়দ বজলুল বারী সুনামগঞ্জ পোস্ট অফিসে টেলিগ্রাম মাস্টার ছিলেন। সৈয়দ জগলুল পাশা একজন উচ্চ পদস্থ অফিসার হিসাবে চাকুরি থেকে অবসরে গেছেন। সৈয়দ মুসলিম আলী একজন ক্রীড়া সংগঠক ও রেফারি ছিলেন। সৈয়দ আফতাব আলী এবং তাঁর পুত্র সৈয়দ নজরুল ইসলাম সুনামগঞ্জ পুরাতন কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন।
অধ্যক্ষ হিসেবে সৈয়দ মুহিবুল ইসলাম মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে নিয়োজিত আছেন। সৈয়দ আলী আহমদ সেনাবাহিনী শিক্ষা কোরে ছিলেন। মাওলানা আমীর খসরু সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি স্কুলের হেড মৌলানা।
সৈয়দ আব্দুল হান্নান একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। সৈয়দ একরামুল হক রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। শাহজামাল চৌধুরী বেঁচে নেই। লে. কর্নেল সৈয়দ আলী আহমদ ও সৈয়দ আতাউর রহমান রাজনীতিতে এখনো সক্রিয়। সৈয়দ কবীর আহমদও রাজনীতি করতেন। সৈয়দ ইয়াসিনুর রশিদ সুনামগঞ্জ পৌরসভার একজন কমিশনার।
সৈয়দপুর একটি ঐতিহ্যমন্ডিত গ্রাম। গ্রামের অনেক কৃতী সন্তান সুদুর অতীত থেকে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রেখেছেন। আমি আমার এই আত্মজৈবনিক লেখায় শুধুমাত্র যাঁদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল এবং যাদেরকে আমি দেখেছি ও যাদের সাহচর্য আমি পেয়েছি তাদের মধ্যেই আমি আমার এই লেখা সীমাবদ্ধ রেখেছি।
পরিশেষে আমি আশা করব সৈয়দপুর কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিক্ষা-অর্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রেখে সৈয়দপুরের সুনাম বৃদ্ধি করে সৈয়দপুরের ঐতিহ্য আরো সুদৃঢ় করবেন।