দিল্লীর মসনদে ফের মোদি

16
জনতাকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন বিপুল বিজয়ে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদি।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারতে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। ঘোষিত ৫৪২ আসনের মধ্যে তারা পেয়েছে ৩৪৬। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট পেয়েছে ৮৭ আসন। অন্যরা পেয়েছে ১০৯আসন। মমতা ব্যানার্জীসহ বিরোধী অনেকেই পরাজয় মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সাত দফায় অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয় ১৯ মে। ১৪ বুথফেরত জরিপের মধ্যে বারোটি আভাস দিয়েছিল আবারও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়তে চলেছে বিজেপি। জরিপগুলোতে ওই জোটের ২৮২ থেকে ৩৬৫ আসন পাওয়ার আভাস মেলে। বুথফেরত জরিপকে বিরোধীরা সরকারের কারসাজি হিসেবে উড়িয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত বুথ ফেরত জরিপই সঠিক প্রমাণিত হয়। তাদের কেউ কেউ দাবি করেছিলেন ইভিএম কারসাজির মধ্য দিয়ে ফল বদলে দিতে পারে ক্ষমতাসীনরা।
লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে এবার ৫৪২ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এককভাবে বিজেপি পায় ২৮৭ আসন। জোটগতভাবে ৩৪৬ আসন। কংগ্রেস এককভাবে পায় ৫৪ আসন। জোটগতভাবে ৮৭ আসন। অন্য দলগুলো পায় ১০৯টি আসন। আমেথি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। সেখানে তিনি স্মৃতি ইরানির থেকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি স্মৃতির থেকে প্রাপ্ত ভোটে পিছিয়ে ছিলেন।
ফল গণনা শুরুর পর কোন টুইট করেননি মোদি। তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি টুইট করেন। তিনি লেখেন, ‘একসঙ্গেই এগিয়ে যাব। একসঙ্গেই উন্নতি করব। একসঙ্গেই শক্তিশালী ভারত গড়ব।’
উত্তর প্রদেশে অখিলেশ যাদব ও তার বাবা মুলায়ম সিং যাদব জয়ের পথে আছেন বলে জানা গেছে। তাদের দুটি আসনই সমাজবাদী পার্টির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এবার নির্বাচনের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে দুদশকের প্রতিপক্ষ মায়াবতীকে সঙ্গে নিয়ে তারা জোট গড়েন। অখিলেশ ও মায়াবতী একজোট হয়ে অনেক সভা সমাবেশও করেন। কিন্তু তাদের জোট কার্যত মোদির ওপর চাপ ফেলতে পারেনি। উত্তর প্রদেশে বিজেপি ও সমমনারা এগিয়ে থাকে ৫৮ আসনে।
তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী টুইট বার্তায় বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন ফলাফল সম্পূর্ণ পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে তিনি তার মতামত জানাবেন। টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ‘বিজয়ীদের অভিনন্দন। কিন্তু পরাজিতরা সব হারায়নি। আমাদের সবকিছু পর্যালোচনা করতে হবে এবং এরপর সবার সঙ্গে আমাদের মতামত শেয়ার করব। এখন গণনা পর্ব পুরোপুরি শেষ হোক ..’
বিবিসি বাংলার দিল্লী সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ বলেন, ভারতের সাধারণ নির্বাচনে ‘বেলওয়েদার স্টেট’ হিসেবে যার পরিচিতি উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যে বেশ কিছু আসন হারাতে পারে বলে সব রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।’ সারাদেশে সর্বোচ্চ, ৮০টি লোকসভা আসন আছে ওই রাজ্যে, ২০১৪ সালে তার মধ্যে ৭৩টিই গিয়েছিল বিজেপির দখলে।
হিন্দি বলয়ের আরও তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে ৬৫টি আসনের মধ্যেও ৬২টি পেয়েছিল বিজেপি। ওই তিন রাজ্যেও এবারে সেই ফলের ধারা ধরে রেখেছে তারা।
পশ্চিমবঙ্গে গতবারের জেতা মাত্র দুটি আসন থেকে একলাফে নয় গুণ শক্তিবৃদ্ধি করে বিজেপি প্রায় আঠারোটি আসন জিতেছে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে বিজেপির যতটা বিপর্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল শেষ পর্যন্ত ততটা হয়নি। রাজ্যে ৫৯টি আসনে জিতেছে বিজেপি। গত বারের তুলনায় তারা সেখানে ১৪টির মতো আসন হারাতে চলেছে। কিন্তু বিজেপির এই সামান্য ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা। ওড়িশাতে তারা গতবার মাত্র একটি আসনে জিতেছিল, সেই জায়গায় বিজেপি এবার সাতটি আসন পেয়েছে। ফলে উত্তরপ্রদেশে যে ১৪টির মতো আসন বিজেপি খুইয়েছে তারা দেড়গুণ আসন তারা পূর্বাঞ্চলীয় দুটি রাজ্য থেকে উসুল করে নিয়েছে। বিজেপির পরিকল্পনাবিদরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই পূর্বভারতকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এর সুফল তারা এখন পেতে শুরু করেছেন।
সারাদেশে বিজেপির আরও একবার বিপুল জয়ের ছবি যখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখনই প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে রাহুলের বাসায় যান। ততক্ষণে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে মাত্র চার-পাঁচ মাস আগেও কংগ্রেস বিজেপিকে হারিয়ে যে রাজ্যগুলো দখল করেছিল সেই মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানেও দলের বিপর্যয় অবধারিত। গতবারের পাওয়ায় মাত্র ৪৪টি আসনের তুলনায় কংগ্রেস এবার বেশ কিছুটা ভাল করছে ঠিকই কিন্তু সেটা যে বিজেপিকে হঠানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না।
মোদি বুঝিয়ে দিলেন জাতীয় রাজনীতিতে তিনি অপ্রতিরোধ্য। তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দাড়াতে পারে এমন কোন নেতা এই মুহূর্তে বিরোধী দলে নেই। শিবসেনার মতে, মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন এমন কোন নেতা আগামী ২৫ বছরে উঠে আসতে পারবে না। বুথফেরত সমীক্ষার সঙ্গে লোকসভা ভোটের ফলাফল মিলে গেছে। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার দেশটির গণমাধ্যম শিরোনাম করতে শুরু করে ‘ফির এক বার মোদি সরকার’।
বিজেপির জয়ের কান্ডারি হিসেবে উঠে আসে মোদির নাম। সেনাপতি অমিত শাহের সঙ্গে মিলে দলকে জেতানোর দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। তার শ্রম অমিতের রণকৌশলে ভর করে বিজেপি এবার সাড়ে তিনশ’য়ের কাছে পৌঁছে যায়। তাই মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ সহযোগী দলগুলো। বিজেপির দীর্ঘদিনের সঙ্গী শিবসেনা মোদির প্রশংসা করে বলেছে ‘গোটা দেশ মোদিময়’।
শিবসেনার পার্লামেন্ট সদস্য সঞ্জয় রাউতের মতে, এনডিএর জয় বিরোধীদের গালে থাপ্পর মেরেছে। ভোটের আগে বিরোধীরা রাফায়েল নিয়ে মোদির বিরুদ্ধে অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। তার মতে, এখন সময় এসেছে বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার। সত্যি এটাই যে মোদির সমতুল্য কোন নেতা এখন নেই। আজকের রায়ের পর এটি পরিষ্কার আগামী ২৫ বছর মোদির বিকল্প কোন নেতা উঠে আসবে না। তিনি আর জানান, গোটা দেশ মোদির নেতৃত্বের ওপর ভরসা রেখেছে। তার নেতৃত্বেই দেশ আগামী পাঁচ বছর বিকাশের পথে এগিয়ে যাবে।
দেশজুড়ে শোচনীয় অবস্থা কংগ্রেসের। মাত্র ৫০টি আসনে এগিয়ে রয়েছে দলটি। এমনকি কংগ্রেস গড় হিসেবে পরিচিত আমেথিতেও হেরে গেছেন রাহুল গান্ধী। দলের এই ফলাফলের পর রাহুল পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে সোশাল মিডিয়ায় খবর রটে।
কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে চান রাহুল গান্ধী। সোনিয়া গান্ধীর উপস্থিতিতেই দলের কাছে রাহুল এই ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দেশজুড়ে দলের এহেন পরাজয়ের সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে দলের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে চান রাহুল। আগামী সপ্তাহেই দলের পরাজয় নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করতে বসতে চলেছে কংগ্রেস। সেখানেই রাহুল গান্ধীর পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হতে পারে বলে জানা গিয়েছে। যদিও এই খবরের কোন সত্যতা নেই বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে কংগ্রেসের তরফে। এদিকে রাহুলকে উদ্দেশ্য করে তার শ্যালক রবার্ট বডরা বলেছেন, ফল যাই হোক না কেন, আমি সব সময় তোমার পাশে রয়েছি। তাহলে কি এই ফলের প্রত্যাশা ছিলই, মানসিকভাবে তৈরিই ছিল কংগ্রেস, এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। রাহুল গান্ধীকে আর ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে পি বলে সম্বোধন করে রবার্ট বলেন, তোমরা সেরা। আমার শুভেচ্ছা তোমাদের সঙ্গে সবসময় রয়েছে। এই বার্তার সঙ্গেই দুটি ছবি পোস্ট করেছেন রবার্ট। একটি নিজের স্ত্রীর সঙ্গে এবং একটি নিজের শ্যালকের সঙ্গে। কংগ্রেস সভাপতিকে শুভেচ্ছা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের সব নেতা, কর্মী, সমর্থকদের তিনি বার্তা দিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদিকে রাহুল গান্ধীর অভিনন্দন : ভারতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো লোকসভা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ায় বিজেপির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী। পাশাপাশি, মোদির সঙ্গে যে আদর্শিক লড়াই তার চলে আসছে, তা একইভাবে চলবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার নির্বাচনের ভোট গণনার পর ফলাফলে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেলে বিকেলে কংগ্রেস কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে রাহুল তার প্রতিক্রিয়া দেন। প্রথমেই তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি এই নির্বাচনে জিতেছেন। তাদের অভিনন্দন। জনগণ যাকে পছন্দ করেছে, তারাই সরকার চালাবেন, জনগণের পছন্দকে সম্মান করতে হবে। কারণ জনগণই রাজা, তারাই সবকিছু ঠিক করেন। নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশে কংগ্রেস সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, যে আদর্শিক লড়াইটা চলে আসছে, সেটা চলতে থাকবে। নির্বাচনে এমন ফলাফলের পেছনে কোন কারণ দায়ী থাকলেও সেটাতে পড়ে না থাকার কথাই বলেন রাহুল। তিনি বলেন, ‘যে ভুল হয়েছে, সেটাতে পড়ে থাকতে চাই না।’