ঐতিহাসিক বদর দিবসের ভাবনা

82

ওলীউর রহমান

১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে রমজান মাসের ১৭ তারিখে ১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। মুসলমানদের ঈমানী শক্তির কাছে কুফরী শক্তির সূচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে সেদিন বদর প্রান্তরে রচিত হয়েছিল ইসলাম ও মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় ইতিহাস। এ যুদ্ধের পর থেকে ইসলামের বিজয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র আরবে এবং পতন ঘন্টা বেজে উঠেছিল বিশ্বের দাম্ভিক শক্তি সমূহের। পবিত্র কোরআনে এ যুদ্ধকে বলা হয়েছে “আল ফুরকান” অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী।
হিজরতের পর রাসূল (সা.) মদিনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে মদিনার অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীগুলোর সাথে একটি শান্তি ও সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এদিকে কুরাইশগণ নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল মদিনায় নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমনকি মদিনায় আক্রমণ করারও তারা পরিকল্পনা করেছিল। এরই অংশ হিসেবে তারা কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিল অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য-রসদ নিয়ে আসার জন্য। রাসূল (সা.) যখন সংবাদ পেলেন যে, আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য রসদের বিশাল সম্ভার নিয়ে মক্কায় ফিরছেন তখন তিনি বদর গিরিপথে আবু সুফিয়ানকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ মক্কায় এই অস্ত্র ভান্ডার পৌঁছলে কুরাইশগণ এই খাদ্য রসদ এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মদিনায় হামলা চালাবে। এ উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসে ৩১৩ জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর গিরিপথের দিকে রওয়ানা দিলেন। এ দিকে কুরাইশরা আবু সুফিয়ানকে সাহায্য করার জন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল এক বাহিনী প্রেরণ করলো।
সাহাবায়ে কেরামের ক্ষুদ্র বাহিনীর মধ্যে ছিল ৭০টি উট, ২টি ঘোড়া, আটখানা তরবারী এবং নয়টা লোহার পোশাক। অন্য দিকে মক্কাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল একহাজার। এর মধ্যে সাত শত উষ্টারোহী, দু’শ অশ্বারোহী এবং তাদের বাহিনী ছিল পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য রসদে সমৃদ্ধ। বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সিপাহসালার ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং মক্কা বাহিনীর অধিনায়ক ছিল উৎবা বিন রবিআ। তাছাড়া মক্কা বাহিনীর সাথে ছিল মক্কার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। যেমন- উমাইয়া বিন খলফ, আবুজেহেল, উৎবা, শায়বা, আবুল বুখতারী, হিশাম, হাকিম বিন হাজম প্রমুখ।
রাসূল (সা.) যখন মক্কাবাহিনীর বিশাল রণপ্রস্তুতির কথা জানতে পারলেন তখন তাদের শক্তি ও প্রাচুর্যের কথা সাহাবায়ে কেরামকে জানিয়ে দিলেন এবং তাদের সাথে পরামর্শ করলেন। রাসূল (সা.) এর হয়ত আশংকা ছিল যে, সাহাবায়ে কেরামগণ এ অসম যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে কি না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম একদিকে ছিলেন রিক্ত হস্ত, খাদ্য-রসদ ও অস্ত্র-শস্ত্র ছিল অপ্রতুল, শত্র“ বাহিনী ছিল নিজেদের থেকে তিনগুণের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে এ যুদ্ধ ছিল সাহাবায়েকেরামের নিজেদের গোত্রীয় লোকদের বিরুদ্ধে। একারণে রাসূল (সা.) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যে বীরত্বও সাহসিকতা প্রত্যক্ষ করলেন তাতে তিনি আনন্দিত হয়ে গেলেন। আনসার নেতা সাআদ বিন মাআজ (রা.) নিজেকে দ্বীনের পথে উৎসর্গ করে এক দীর্ঘ জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন- ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার সত্যতা স্বীকার করেছি এবং আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনার আনিত দ্বীন সম্পূর্ণ সত্য। হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি মদীনা থেকে বের হয়েছেন এক ইচ্ছা নিয়ে, কিন্তু আল্লাহ এখন অন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এখন আপনার যা মর্জি হয় করতে পারেন। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার সাথে আছি। আপনি আমাদের কে যা ইচ্ছা তা নির্দেশ দেন, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আপনি আমাদেরকে মহাসমুদ্রে ঝাপ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও আমরা মহাসমুদ্রে ঝাপ দিতে প্রস্তুত। আমাদের মধ্য থেকে কেউ পিছনে থাকবেনা।’ (যুরকানী ১ম খন্ড)
রাসূল (সা.) সাহাবাদের এরূপ বক্তব্য শুনে নিতান্ত খুশী হলেন এবং স্বয়ং আল্লাহ পাকও সাহাবাদের এসব বক্তব্যের উপর সন্তুষ্ট হয়ে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ফায়সালা করে দিলেন। উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ প্রায় আসন্ন। রাসূল (সা.) আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করলেন, ‘হে পরওরদেগার! তোমার ওয়াদা পূর্ণ কর- এই কুরাইশ বাহিনী নিতান্ত অহংকার ও দাম্ভিকতার সাথে অগ্রসর হচ্ছে, ওরা আপনার বিরোধীতা করছে। হে আল্লাহ! তোমার ওয়াদা পূর্ণ কর, আমাদের বিজয় দান কর।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)
রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় হাবীবের দোয়া কবুল করলেন, আল্লাহও তাঁর রাসূলের প্রতি অকুন্ঠ আনুগত্যশীল, শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবীত মুসলিম বাহিনীর প্রতি আসমানাী সাহায্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। বৃষ্টির মাধ্যমে রাব্বুল আলামীন বদরের বালুকাময় স্থানকে শক্ত করে দিলেন। অন্যদিকে মুসলমানগণ নিজ নিজ পাত্রে পানি সংরক্ষণ করে নিলেন, ফলে বিরাট সংকট থেকে মুক্তি পেল মুসলিম বাহিনী। ১৭ রমজান যুদ্ধ শুরু হলো। ‘হয়ত শহীদ নয়ত গাজী’ শাহাদাত প্রিয় মুসলিম বাহিনীর সামনে এই সমান সুমহান দুটি পথ। মুসলমানদের আন্তরিকতা ও ঈমানী শক্তির কারণে মহান রাব্বুল আলামীন বদর প্রান্তরে পাঁচ হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করলেন। যুদ্ধের প্রাথমিক বিজয় মুসলমানদের পদচুম্বন করল। কুরাইশের শক্তিশালী তিন নেতা উতবা, শাইবা ও ওয়ালিদ নিহত হলো মুসলিম বাহিনীর আমীর হামজা, আলী এবং উবায়দা (রা.) এর হাতে। দুই যুবক মাআজ এবং মুআওয়াজের হাতে নিহত হলো বিখ্যাত কুরাইশ নেতা আবু জেহেল। আরেক প্রভাবশালী নেতা উমাইয়া বিন খালফ সূচনীয় ভাবে মৃত্যু বরণ করল তার এক সময়ের কৃতদাস হযরত বিলাল (রা.) এর হাতে। এভাবে একের পর এক কুরাইশ বাহিনীর অনেক নেতা মৃত্যুমুখে পতিত হলো এবং মুসলিম বাহিনীর বিজয়কেতন উড্ডীন হলো বদর প্রান্তরে। মুসলমানদের মধ্যে শহীদ হলেন ১৪ জন এবং কাফের বাহিনীর মৃত্যুবরণ করলো ৭০ জন এবং বন্দী হলো আরো ৭০ জন।
মুসলমানদের ৩১৩ জনের ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে সেদিন পরাজিত হয়েছিল মক্কার একহাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। অথচ মুসলিম বাহিনীর জনবল, যুদ্ধ উপকরণ ছিল একেবারে সীমীত। সে সময়ের তুলনায় আজ মুসলমানদের শক্তি সামর্থ ও জনসংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু তার পরও সারা বিশ্বে মুসলনারা ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সহ ইসলাম বিদ্ধেষীদের হাতে মার খাচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মুসলমানগণই। ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মিরও আমাদের প্রতিবেশি মিয়ানমারের আরাকানের দিকে তাকালে মনে হয় যেন মুসলমানরাই একমাত্র সেই জাতি যাদের জীবন, সম্পদ, ঘরবাড়ি এবং তাদের মা-বোনদের ইজ্জতের কোন মূল্য নেই। যেভাবে ইচ্ছা কাফের মুশরিকেরা মুসলমানদের মারতে পারে, তাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের সম্পদ দখল করতে পারে, তাদের মা-বোনদের ইজ্জত-আবরু যত ইচ্ছা লুন্ঠন করতে পারে। শুধু তাই নয় আজ পৃথিবীতে যারা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকারের কথা বলে তাদের নেতৃত্বেই মুসলিম নিধন চলছে দেশে দেশে।
আজ মুসলমানরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নিগৃহিত ও নিপীড়িত জাতি। নিকট অতীতে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, মিয়ানমারে যত মুসলমান মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠিত হয়েছে তা একত্রিত করলে গোটা পৃথিবী কালো মেঘে ছেয়ে যাবে, যত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে তাদের হাড়গুলো একত্রিত করলে একটি হিমালয় পর্বতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে, তাদের রক্ত গুলো একত্রিত করা হলে ফুরাত নদীর মত একটি নদী হয়ত বয়ে যাবে। আজ আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে মুসলমানদের বুক ফাটা আর্তনাদ। মনে হচ্ছে যেন মুসলমানদের যোগ্য কোন আভিভাবক নেই, কোন আশ্রয় নেই। অথচ এই মুসলমানরাই এক সময় গড়েছিল সভ্যতার সোনালী ইতিহাস-শাসন করেছিল অর্ধ পৃথিবী। ইতিহাসের এই বিজয়ী জাতির আজ এই দুর্দশা কেন? আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের এই চরম দুর্দশার একমাত্র কারণ হলো মুসলমানদের ঈমানী দুর্বলতা এবং কাপুরুষতা। মুসলিম বিশ্ব আজ বহুদাবিভক্ত। মুসলমানরা আজ তাগুতী শক্তির ক্রীড়নক। ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাকও আরাকান জুড়ে কাফের মুশরিকেরা মুসলিম নিধনের মহড়া দেয়, ইসরাঈলী হায়নারা ফিলিস্তিনের মা-বোনদের বুকে উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করে, পিতার সামনে মেয়ের ইজ্জত লুন্ঠন করে, মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা মুসলমানদের কচুকাটা করে অথচ মুসলিম নেতারা এই সব জুলুমের প্রতিবাদ টুকুও করতে ভয় পায়। এ অবস্থায় আল্লাহর সাহায্য আসবে কি করে? বদর প্রান্তরে মুসলমানদের মাঝে যে ঈমানী শক্তি, ঐক্যও মমত্ববোধ, একনিষ্ঠতা ছিল, সাহাবাগণ যেভাবে ছিলেন কুফুর শিরকের বিরুদ্ধে আপোসহীন এসবের কিছুই তো আজ মুসলিম বিশ্বে নেই। আছে শুধু দ্বন্দ্ব-কলহ, ক্ষমতার লোভ, বিলাসিতা ইত্যাদি। বিশ্বের কোন একটি দেশে ইসালামপন্থীদের মধ্যেও সুদৃঢ় ঐক্য নেই। আর একারণেই আজ মুসলিমবিশ্বের এই অবস্থা। আল্লাহর সাহায্যও মদদ থেকে আমরা বঞ্চিত। যদি আমরা বদরের বিজয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং সাহাবায়ে কেরামের ঈমানী চেতনায় যদি উজ্জীবিত হতে পারি, তাহলে আজও পৃথিবীতে ইসলামের পতাকা উচ্চকিত থাকবে, আমাদের সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, মুসলমানদের এই দুর্দশা দূর হবে। পৃথিবীর কোন তাগুতী শক্তি মুসলমানদের ধমিয়ে রাখতে পারবে না।