সাড়ে ১৫ মাসে সিলেট বিভাগে বজ্রপাতে ২৯ জনের প্রাণহাণি

55

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সিলেট বিভাগে গত সাড়ে ১৫ মাসে বজ্রপাতে আনুমানিক ২৯ জনের প্রাণহাণির ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হচ্ছে সুনামগঞ্জ। সে সুনামগঞ্জে জেলায় বজ্রপাতে ২০১৬ সালে ১৮ জন, ২০১৭ সালে ৮ জন আর ২০১৮ সালে ২০ জন মারা গেছে। এছাড়া নতুন বছরের ৮ ও ৯ এপ্রিল সুনামগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জে মিলিয়ে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে ৩ কৃষকসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, সাধারণ লোকজন বজ্রপাতের কারণ হিসেবে বলে বেড়ান চোররা কৌশলে মৌজা কুঠি তুলে নিয়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতে সিলেটে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। তবে এসব কুঠিতে কি রয়েছে তা সঠিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। গত প্রায় দুই যুগ ধরে হাওর অঞ্চলে মৃত্যু ঘটতে থাকলেও এভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে নেই তেমন কোনো প্রস্তুতি। এ অবস্থায় শুরু হতে যাচ্ছে আরেকটি বর্ষা মৌসুম ১৪২৬ বাংলা। এছাড়া বজ্রপাত হলে লাশ চুম্বক হয়ে যায় বলে এলাকায় মানুষের মাঝে এক ধরনের রিউমার আছে। এ কারণে অনেক সময় মৃতদেহ চুরির আশঙ্কা দেখা যায়।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বেশি ১০৫টি হাওর আছে সিলেট জেলায়। আর সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর আছে ৯৫টি। সংখ্যায় সিলেট জেলায় হাওর বেশি হলেও আয়তনের দিক দিয়ে হাওর এলাকা বেশি সুনামগঞ্জে। বজ্রপাতে বেশি প্রাণহানিও ঘটে এই জেলায়।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, আজ পহেলা বৈশাখ থেকে ঝড়বৃষ্টি আর বজ্রপাতের পরিমাণ আরো বাড়বে। এটাই হাওরের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময়। হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান তোলা হয় এ সময়। ফলে হাওরের কৃৃষকদের মাঠে যেতেই হয় এ সময়টাতে। এতে প্রাণহাণি আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাওর এলাকায় গত ২ বছর লক্ষাধিক তালবীজ রোপণ করা হয়। তবে এ উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। বেশির ভাগ তালবীজ থেকেই চারা গজায়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ এপ্রিল দুপুরে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় তেরাকুঁড়ি এলাকায় কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে ৩ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তারা হচ্ছে- উপজেলার রেংগা হাজিগঞ্জ তেরাকুঁড়ি গ্রামের তজমুল আলীর পুত্র জিতু মিয়া (৩৫), গোলাপগঞ্জের লক্ষ্মীপাশা গাসিবন গ্রামের মস্কন্দর আলীর পুত্র রাজন মিয়া (২৮), একই গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের পুত্র আনোয়ার হোসেন (৪২)। তাদেরকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়েশা হক নিহত ৩ কৃষককের প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় উত্তর কুশিয়ারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহমেদ জিলু প্রত্যেকের পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেন। এছাড়া ৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জে ২ জনের মৃতের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।
২০১৮ সালের ২৬ মে সন্ধ্যায় সিলেট বজ্রপাতে সদর উপজেলার মীরেরগাঁওয়ের জিলকার হাওরে ৩ ভাইয়ের মৃত্যু হয়। এরা হলেন-মীরেরগাঁওয়ের বদই আলীর ছেলে আমিন (২০) বাবুল, (১২) ও ইমন (৮)। সন্ধ্যায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে মীরেরগাঁওয়ের জিলকার হাওরে মাছ ধরতে যান ৩ ভাই। এসময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। একই বছরের ৬ মে সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাটে উপজেলার নন্দিরগাও ইউনিয়নের চলিতাবাড়ির মাঝহাটি গ্রামে বজ্রপাতে মকবুল আলী (২৮) নামে এক জেলের মৃত্যু হয়। প্রতিদিনের মতো নদীতে মাছ শিকার করতে যান জেলে মকবুল আলী। হঠাৎ বৃষ্টি চলাকালে বজ্রপাতে মকবুলের মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে নিহত মকবুল আলীর পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এই ঘটনার এক সপ্তাহে আগেও এ উপজেলায় বজ্রপাতে আরো ২ জন মারা গিয়েছিলেন। ১ মে দুপুরে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা কানাইঘাট উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের উপরবড়াই গ্রামের হাওরে তোফায়েল আহমদ তামিম ও সালমান আহমদ নামে ২ কিশোর বজ্রপাতে মারা যান। নিহত তোফায়েল স্থানীয় উপরবড়াই গ্রামের করিম আলী বতাইয়ের পুত্র ও সালমান একই গ্রামের ফখরুল ইসলামের পুত্র। এ ২ কিশোরের বাবা বাড়ির পাশের হাওরে বোরো ধান কাটছিলেন। দুপুরে তাদের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই দু’জন মারা যান। এছাড়া বাকী নিহত ও আহতদের নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বজ্রপাতকে একটি দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। ১২ ঘণ্টা আগে আমরা বজ্রপাতের পূর্বাভাস পাই। আমরা যে বজ্রপাত পূর্বাভাস সরকারি দপ্তরে পাঠাই, সেটি হাওরাঞ্চলের মানুষজনের কাছে পৌঁছতে হবে। এটি স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদেরই করতে হবে। পূর্বাভাস পেলে ওই সময় হাওরে কাজ করা থেকে তারা বিরত থাকতে পারবেন। তবে ডিজিটাল মাধ্যমে যে কেউ আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে পারবেন বলে জানান এ কর্মকর্তা।