দিনমজুর রুহেলকে মিষ্টি খাইয়ে হত্যার ঘটনা ॥ গোলাপগঞ্জে হত্যার ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা, উপজেলায় তোলপাড়

76
গোলাপগঞ্জে বিষাক্ত মিষ্টি খেয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা অপর ৩ দিনমজুর। (ইনসেটে) মারা যাওয়া দিনমজুর রুহেল।

সেলিম হাসান কাওছার গোলাপগঞ্জ থেকে :
গোলাপগঞ্জে লক্ষ্মীপাশায় দিনমজুর রুহেল আহমদকে মিষ্টি খাইয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশ অপমৃত্যু মামলা নিয়েছে। এ নিয়ে গোটা উপজেলায় তোলপাড় চলছে। গত ২৩ মার্চ চার দিনমজুর শ্রমিকদের বিষাক্ত মিষ্টি খাইয়ে দিনমজুর রুহেল আহমদকে হত্যার ঘটনায় পুলিশ আসামীদের বাঁচাতে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের সময় দিনমজুর পরিবারকে মামলা ও আসামী ধরার আশ^াস দিয়ে মামলার অভিযোগের বদলে অপমৃত্যুর কাগজে স্বাক্ষর করায়। আর এই অপমৃত্যুর কাগজে উল্লেখ করা হয় রুহেল শ^াসকষ্টে মারা গেছে। এ ঘটনা প্রকাশের পর নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
রুহেল নিহতের ঘটনায় স্বজনরা থানা পুলিশের দ্বারে-দ্বারে অনেক কান্না করেও কোন কাজ হয়নি। বরং মামলা না নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ভয় ভীতি দেখিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের গ্রামবাসী মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচীও পালন করেছেন। ২৯মার্চ ও ৭ এপ্রিল দুপুরে লক্ষ্মীপাশা বাজারে দিনমজুর রুহেল হত্যার প্রতিবাদে বিশাল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদ সভায় বক্তারা এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও দ্রুত গ্রেফতারের দাবী জানান। তাছাড়া আসামীদের গ্রেফতারের দাবী জানিয়ে ও পুলিশি হয়রানির বিষয়টি উল্লেখ করে লক্ষ্মীপাশা ইউপির বিভিন্ন গ্রামের লোকজন লিখিত একটি অভিযোগ সিলেটের ডিআইজি বরাবরে দিয়েছেন। সাত এপ্রিল দেয়া ওই অভিযোগে বিভিন্ন গ্রামের ১৮২ জন লোক স্বাক্ষর করেন। ওই কর্মসূচী শেষে নিহত স্বজন ও আহতরা সাংবাদিকদের জানান, আমাদের ইউনিয়নের ঘাসিবর্ণি গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে আলমগীর (২২), একই গ্রামের মছব্বির আলীর ছেলে নাজিম উদ্দিন (২৩), একই গ্রামের হুরমত আলীর ছেলে এনাম উদ্দিন (৪২), উত্তর জগঝাপ গ্রামের মইনুদ্দিনের ছেলে আনু মিয়া (২৪), দক্ষিণ লক্ষ্মীপাশা গ্রামের রকিব আলীর ছেলে নুর উদ্দিন (৪৫) ও লক্ষ্মীপাশা ঘাসিবর্ণি গ্রামের মৃত কুশিদ আলীর ছেলে (নিহত) রুহেল আহমদ (২৬) দিনমজুর শ্রমিক আমাদের ইউনিয়নের উত্তর জলঝাপ গ্রামের মৃত ছমির খাঁর ছেলে নানু খাঁর বাড়ীর পাশে ৬/৭দিন থেকে উনার বাড়ীতে মাটি কাটার কাজ করে আসছিলেন। প্রতিদিন দুপুরে তাদের চা-বিস্কুট দিয়ে যেতেন নানুর আপন চাচাতো ভাই নামর খাঁর ছেলে রিয়াদ আহমদ (১০)। তাদের কাজের মালিক নানুর সাথে জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল নানুর আপন ভাই মাহমুদ খাঁ ও চাচাচো ভাই নামর খাঁর সাথে। মাটি কাটা নিয়ে দুইদিন তাদের উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বও বাঁধে। দিনমজুর শ্রমিকরা বিষয়টি মিমাংসা করে দেন। গত মাসের ২৩/৩/২০১৯ইংরেজী তারিখ দুপুর অনুমান ২টা ৩০ঘটিকার সময় আমাদের ৬জন শ্রমিকের মধ্যে লক্ষ্মীপাশা ইউপির দক্ষিণ লক্ষ্মীপাশা গ্রামের রকিব আলীর ছেলে দিনমজুর নুর উদ্দিন (৪৫), ঘাসিবর্ণি গ্রামের মছব্বির আলীর ছেলে নাজিম উদ্দিন (২২) ও একই গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে আলমগীর হোসেন (২২) ক্লান্ত হয়ে জমির উপর তারা বসেছিলেন। এ সময় নামর খাঁর ছেলে রিয়াদ আহমদ (১০) তাদের মিষ্টি দিয়ে গেলে তারা মিষ্টি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মিষ্টি খাওয়ার পর ছটফট শুরু করলে স্থানীয়রা দেখতে পেয়ে তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার রুহেল আহমদ (২৬) কে মৃত ঘোষণা করেন এবং অপর আহত শ্রমিকদের সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে আহতরা চিকিৎসা নিয়ে ভাগ্যক্রমে বাড়ী ফিরেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আহত ৪জনকে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার আমাদের জানান আমাদের প্রাথমিক ধারণা বিষক্রিয়ায় রুহেলের মৃত্যু হয়েছে এবং আহতদের শরিরে বিষ রয়েছে। ঘটনার খবর পাওয়ার পর গোলাপগঞ্জ থানার এসআই ফয়জুল করিম নিহত রুহেলের ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। রুহেলের লাশ গ্রহন করার সময় নিহতের স্বজনরা আসামীদের গ্রেফতারের দাবী জানালে দারোগা ফয়জুল করিম সাহেব মামলার কাগজে স্বাক্ষর করানোর কথা বলে কৌশলে নিহতের বড় ভাই দিনমজুর সাকু আহমদের স্বাক্ষর নেন। পরে আমরা জানতে পারি অপমৃত্যুর কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন দারোগাসাব। পরে নিহতের দিনমজুর পরিবার মামলা করার জন্য থানা পুলিশের কাছে বার বার গেলে পুলিশ তাদের মামলা নেয়নি। উল্টো ভয় ভীতি দেখিয়ে থানা থেকে তাড়িয়ে দেন। বিষয়টি নিহতের গ্রামের মেম্বার হেলাল আহমদকে অবগত করা হলেও কোন কাজ হয়নি। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসা শ্রমিকরা জানান সেখানকার ডাক্তার জানিয়েছেন বিষক্রিয়ার কারণে তারা অসুস্থ হয়েছেন। তবে এখন তারা আশঙ্কা মুক্ত। মামলা দায়েরের চেষ্টা চলছে জানতে পেরে কাজের মালিক নানু মিয়া রাতে কাজের শ্রমিকদের টাকা দেওয়ার কথা বলে বাড়ীতে নিয়ে আটকিয়ে নির্যাতন ও পুলিশের মাধ্যমে ভয় ভীতি দেখান। কোন উপায় না পেয়ে ৩/০৪/২০১৯ইংরেজী নিহতের বড় ভাই দিনমজুর জুয়েল আহমদ বাদী হয়ে সিলেটের একটি আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। শ্রমিকরা যার বাড়ীতে কাজ করতেন মৃত ছমির খাঁর ছেলে নানু খাঁ ৪/০৪/২০১৯ ইংরেজী সৌদিতে চলে গেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। একি অভিযোগ উল্লেখ করা হয় ডিআইজির অভিযোগ পত্রেও। মিষ্টি খেয়ে আহত হওয়া দক্ষিণ লক্ষ্মীপাশা গ্রামের রকিব আলীর ছেলে ট্রাক্টর চালক নুর উদ্দিন জানান,পুলিশ অপমৃত্যুর কাগজে উল্লেখ করে রুহেল শ^াসকষ্ট হয়ে মারা গেছে। নিহতের জমজ ভাই জুয়েল আহমদ জানায়,আমার ভাইয়ের কোন ধরণের রোগ ছিল না। সে অসুস্থ হলে’ত মাটি কাটার মত কঠিন কাজ করতে পারতো না। রুহেল আমাদের ৪ ভাই ও এক বোনের মধ্যে ছোট ছিল। গত ৫এপ্রিল নিহতের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। নিহতের মা রিনা বেগম (৬০) ছোট ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, সাকু (৩০), সুহেল (২৮), জুয়েল (২৫) ও ছোট ছেলে নিহত রুবেল (২৫) সকলেই দিনমজুরের কাজ করেন। আর রিতা বেগম (৩২) ভাই বোনের মধ্যে সকলের বড়। অভাবের সংসারে তাদের কাউকে পড়া লেখা করাতে পারিনি। এ বিষয়ে এসআই ফয়জুল করিমের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, নিহতের স্বজনরা কাগজ পড়েই স্বাক্ষর করেছেন। এ ব্যাপারে সিলেট জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ মাহবুবুল আলমের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি দেখছি।