আল কুরআনে বর্ণিত বিশেষ দোয়া

31

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
কুরআন মজীদ সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সরাসরি নাযিল হয়েছে, এজন্য তাঁর প্রার্থনা ও মোনাজাত বর্ণনার ভাষায় ভিন্নতা রয়েছে। তাঁর অধিকাংশ দোয়াই আল্লাহ পাক তাঁকে ওহীর মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষা দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো দোয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, মুমিন মুত্তাকীগণ এভাবে দোয়া করে, এই পরিস্থিতিতে এই ভাষায় প্রার্থনা করে এবং ধৈর্যধারণ করে বিনয়াবনত হয়। এগুলিও পরোক্ষভাবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোনাজাত। কারণ তিনি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মুমিন ও মুত্তকী। সুতরাং সে প্রার্থনা সৎ, নেককার, মুমিন ও মুত্তাকীদের, সে প্রার্থনা অবশ্যই সর্বাগ্রে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম এর। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের প্রথম সূরায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতকে সমগ্র জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। এ দোয়ার গুরুত্বের কারণে এর পূর্ববর্তী স্বীকার্য ও করণীয় বিষয়গুলোও স্পষ্টরূপে আলোচিত হয়েছে।
প্রথমেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে সকল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা, জীবনদাতা, পালনকর্তা ও মৃত্যুদাতা হিসাবে মুখে ও মনেপ্রাণে স্বীকার করতে হবে এবং এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, সকল প্রশংসার মালিক একমাত্র তিনিই। তিনি পরম দয়ালু, মৃত্যুপরবর্তী কর্মফল দিবসের মালিক। এরপর বলা হয়েছে, আমরা সকলে যেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করি এবং একমাত্র তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রার্থিত বিষয় ও প্রার্থনার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, আমরা যেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব মাহাত্য ও সপ্রশংসা মহিমা ঘোষণা করে তাঁর নিকট বিনয়াবনত চিত্তে সকাতর প্রার্থনা নিবেদন করে বলি, ‘(হে আল্লাহ), আমাদেরকে আপনি সরল পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ, যাদেরকে আপনি অনুগ্রহ দান করেছেন, যারা ক্রোধ-নিপতিত নয়, পথভ্রষ্টও নয়’। ফাতিহা ৫-৭, এই দোয়া পাঠ করার পর আমীন বলা সুন্নত। আমীন অর্থ, হে আল্লাহ আপনি কবুল করুন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) ও হযরত ওয়াইল ইবনে হুজুর থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘গাইরিল মাগযুবি আলাইহিম ওয়ালায যাল্লীনা’ পাঠ করার পর আমীন বলতেন।-মুসনাদে আহমেদ; আবু দাউদ; তিরমিযী; ক্বালাত তিরমীযিয়্যু : হাযা হাদীসুন হাসানুন।
দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা : সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখতে হবে। আল্লাহকে স্মরণ রাখতে হবে। বিশেষ করে হজ্বের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার সময় গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধিক পরিমাণে আল্লাহ পাকের যিকির করতে হবে। অতঃপর অত্যন্ত বিনয়াবনত হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট দোয়া করতে হবে। কারণ এটি দোয়া কবুলের সময়। শুধু দুনিয়াবী বিষয়ে প্রার্থনা করলে চলবে না; বরং উভয় জগতের কল্যাণের জন্য দোয়া করতে হবে। এজন্য আল্লাহ পাক সেই সকল মুমিনকে সফলকাম বলে প্রশংসা করেছেন, যারা সর্বাবস্থায় বিশেষ করে হজ্বের কাজগুলো সমাপ্ত করার পর উভয় জাহানের কল্যাণে কামনা করে প্রার্থনা করে-‘‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতান ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতান ওয়াকিনা আজাবান না’র’’ ‘‘হে আমদের রব! আমাদেরকে ইহকালে কল্যাণ দিন এবং পরকালেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।-সূরা বাকার-২০১
এই দোয়ায় দুনিয়া ও আখিরাতের সব ধরনের কল্যাণ লাভ করার এবং পরকালের সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে আত্মরক্ষার প্রার্থনা করা হয়। ইহকালীন কল্যাণের মধ্যে জাগতিক সব প্রার্থিত বিষয় শামিল রয়েছে। যেমন মানসিক শান্তি, সুপ্রশস্ত নিবাস, উত্তম ও সুদর্শন জীবনসাথী, জীবিকার প্রাচুর্য, উপকারী ইলম ও সুখকর প্রশংসা ইত্যাদি। পরকালের কল্যাণের মধ্যে রয়েছে সব রকম ভীতিকার বিষয় থেকে মুক্তি, হিসাব সহজ হওয়া এবং আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পুরস্কার জান্নাত লাভ করা। জাহান্নাম থেকে নাজাতের প্রার্থনায় রয়েছে যে সব কাজ দ্বারা জাহান্নামে অগ্নিদগ্ধ হতে হবে, সেসব গোনাহ, পাপ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ থেকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সামর্থ্য লাভ করা। হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দোয়া সর্বদা পাঠ করতেন-‘‘আল্লাহুম্মা রাব্বানা আতিনা ফিদ্ দুনিয়া হাসানাতান ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাউ ওয়াকিনা আজাবান না’র হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা পাঠ করতেন, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার জনৈক অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলেন। দেখলেন তিনি শুকিয়ে পাখির বাচ্চার মতো হয়ে গেছেন। নবীজী তাকে বললেন, তুমি আল্লাহর কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা কর? তিনি বললেন জ্বী হাঁ, আমি বলি, ‘হে আল্লাহ পরকালে আমার জন্য যে শাস্তি রয়েছে তা আপনি দুনিয়ায় দিয়ে দিন।’ একথা শুনে নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলে উঠলেন, সুবহান্নাল্লাহ! তুমি তা সহ্য করতে পারবে না-‘‘হে আমার রব! আমাদেরকে ইহকালে কল্যাণ দিন এবং পরকালেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন। -সূরা বাকারা-২০১” নবীজীর নির্দেশক্রমে সাহাবী এই দোয়া করেন এবং রোগমুক্ত হন।-সহীহ মুসলিম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রুকনে ইয়ামনী ও হজ্বরে আসওয়াদের মধ্যখানে রাব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিনা আযাবান নার, পাঠ করতে শুনেছেন-‘‘রাওয়াহুল ইমামুশ শাফিয়িয়্যু ওয়ার রুয়াতু কুল্লুহুমহ সালিহুন ওয়া বা’জুহুম ফাওক্বা বা’জিন।’’
আরশের উপহার : আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমের সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলোতে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সকল মুমিনের প্রশংসা বলেছেন, তারা সকলে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহ পাকের প্রতি, তার ফেরেশতাগণের প্রতি, আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি এবং আল্লাহর সকল নবী রাসূলের প্রতি। তারা নবী রাসূলদের মাঝে কাউকে বিশ্বাস ও কাউকে অবিশ্বাস করার ন্যায় পার্থক্য করে না এবং তারা আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করে, আমরা শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা আপনার নিকট ক্ষমা চাই। প্রত্যাবর্তন তো আপনারই নিকট। “হে আমাদের, প্রতিপালক যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়ারও করবেন না।” “হে আমাদের রব, আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন আমাদের উপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না।” “হে আমাদের প্রতিপালক, এমন ভার আমাদের উপর অর্পণ করবেন না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনিই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে বিজয়ী করুন।’’-সুরা বাকারা ২৮৫-২৮৬ (অসমাপ্ত)