অগ্নিঝরা মার্চ

77

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষদিন। জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৪ দফা পূর্বশর্ত মেনে নেয়ার দাবিতে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক- পেশাজীবী সংগঠন এবং যুব মহিলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপনেতা খান আবদুল ওয়ালী খান আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে দেড়ঘণ্টাব্যাপী আলোচনাকালে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামারুজ্জামানসহ অন্যান্য নেতা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে অপেক্ষমাণন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনের জন্যই আমাদের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতে এক বিবৃতিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে নতুন নির্দেশ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করা যাবে না। আমরা অজেয়। কারণ, আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে সকালে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ শেষে মিছিলসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার হাতে একটি আবেদনপত্র দেয়া হয়। তাতে নেতারা যে কোন নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বিজয় অর্জনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিষদকে শহরের কয়েকটি স্থানে চেকপোস্ট বসানোর নির্দেশ দেয়। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সম্পদ যাতে বিমানবন্দরের পথে অথবা অন্য কোন পথে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হয় কিংবা সেনাবাহিনীর হাতে চলে না যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করেন। ছাত্র ইউনিয়নের একটি বিশাল মিছিল ঢাকার বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। ঢাকার প্রধান দৈনিকসমূহে প্রদত্ত এক যৌথ বিবৃতিতে রাজনৈতিক সঙ্কটকে সামরিক কায়দায় মোকাবেলা করার তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়- জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সেনাবাহিনীর কাজ বহিরাক্রমণ থেকে দেশকে সুরক্ষা করা; রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা নয়। তাই অতিদ্রুত সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধান করার জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানানো হয়। পিপিপি প্রধান ভুট্টো অভিযোগ করেন, ৬ দফার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মূলত স্বাধীনতা দাবি করছে। করাচীতে নিশাত পার্কে পিপলস পার্টির উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় পিপিপির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান। বরিশালে এক জনসভায় বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অস্থায়ী সরকার গঠন করার আহ্বান জানান। ১১৫ নং সামরিক নির্দেশের প্রতিবাদে দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা নগরীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে তারা বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে বর্তমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘মন্টেসেলো ভিক্টরি’ নামের আরেকটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচী নিয়ে যাওয়া হয়। ‘ওসান এন্ডুরাস’ নামের সমরাস্ত্রবাহী আরেকটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০নং জেটিতে নোঙর করে বন্দর শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে ৯ মার্চ ১৬নং জেটিতে সমরাস্ত্রবাহী অপর জাহাজ ‘সোয়াত’র সমরাস্ত্র খালাসের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিটেজ হরাইজন’ এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচী বন্দরে পরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানান। চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ সারা শহরে মিছিল করে। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ এই মিছিলে অংশগ্রহণ করে। জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় চট্টগ্রাম শহর। বিকেলে চকবাজারের উর্দু গলিতে মিছিলে হানা দেয় বিহারীরা। সাত বাঙালী গুরুতর আহত হন। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে নেয়ার পথে দুজন মারা যান। রাতে উত্তেজিত মুক্তিকামী মানুষ উর্দু গলিতে আক্রমণ করে। বিহারী-জামায়াতীদের সঙ্গে বাঙালীদের মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুলিশের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষ শেষ হয়। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পাক আর্মির একটি ট্রাক এসে চকবাজারের মোড়ে প্রায় পনেরো বাঙালী যুবককে তুলে নিয়ে যায়। সারারাত টর্চার করে ভোরে কোতোয়ালি থানার সামনে ফেলে দেয়া হয়।