অগ্নিঝরা মার্চ

54

কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্বাধীন বাংলার দাবিতে অবিচল সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে সবধরনের অসহযোগিতা অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে শরিক হয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারী অফিস বর্জন করেন। আজও সচিবালয়, মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ সকল সরকারী ও আধাসরকারী ভবন এবং বাসগৃহের শীর্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে। ন্যাপ (ওয়ালী) পূর্ববাংলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ, দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে পৃথক পৃথক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রামী জনতা সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এই দিন বরিশাল কারাগার থেকে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে ২ জন কয়েদি নিহত ও ১০ জন আহত হয়। সিলেটে রেশন নেয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেয়া হয়। যশোরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪ নং সামরিক আদেশ জারি করে নির্দেশ দেন যে, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারী সম্পতির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্রবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের শামিল বলে গণ্য হবে, যা সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য। টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান সাত কোটি বাঙালির নেতা। নেতার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই এক ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন রকম বিরোধ থাকা উচিত নয়। জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় ভুট্টো বলেন, উদ্ভূত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমরা আজ বিরাট সঙ্কটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যত আজ অনিশ্চিত। এ বিষয়ে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করতে হবেই। করাচীতে গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হচ্ছে। দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে যথা শীঘ্রই ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন ঢাকার সরকার প্রধান। সেখানে সব সরকারী কর্মচারী এবং সচিবরা তাঁর নির্দেশ পালন করছেন। ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দফতরে পাকিস্তানী পতাকা উড়ছে। তিনি আরও বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দুই অংশকে এক রাখা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। আজ পূর্ব পাকিস্তানের গর্বনর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ নেয়ার কথা থাকলেও বিচারপতি বি.এ.সিদ্দিকী শপথ বাক্য পাঠ করাননি। এ নিয়ে চট্টগ্রামে আনন্দ মিছিল বের হয়। এ রকম একটি মিছিল দেওয়ানহাট হয়ে হালিশহরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ পথে বিহারী জল্লাদরা তলোয়ার আর গুলি নিয়ে মিছিলরত নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের আক্রমণ করে। এ ঘটনায় পনেরো-বিশজন বাঙালী নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার খবর আসে। প্রত্যুত্তরে কিছু বাঙালী যুবক টাইগার-পাসে দুইজন বিহারীকে গুলি করে। এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় আর্মি সারা শহরে টহল দেয়। থমথমে হয়ে যায় পুরো শহর। আর্মির গাড়িতে বিহারী জল্লাদরাও ছিল। আগ্রাবাদ মোড় হতে পাঁচ-ছয়জন বাঙালী যুবককে তুলে নেয়ার খবর পাওয়া যায়। এদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।