শুদ্ধ বাংলা চর্চা

139

রেহানা পারভীন মুক্তা
একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছিলেন -‘ভাষায় ভ্রান্ত ব্যবহার নিজ মাতৃভাষাকে হত্যার শামিল আর ভাষার মধ্যে ইংরেজির ব্যবহার হীনমন্যতার পরিচায়ক’। হ্যাঁ, আমরা প্রতিনিয়ত মাতৃভাষাকে হত্যা করছি এবং ভাষার মধ্যে ইংরেজি ব্যবহার করে হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছি। কিন্তু এই মাতৃভাষার অর্জন একদিনে হয়নি। সেই ১৯১১ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম। অবশেষে এল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তে কেনা দিন, বড় বেদনার দিন, বড় করুণ দিন, সারা পৃথিবীকে অবাক করা দিন। কারণ এই দিনে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্যে প্রাণ দিয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহ সহ নাম না জানা অনেক তরুণ। অনেক তাজা প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলা ভাষা। কিন্তু সেটাকে রক্ষা করতে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছি।
আমাদের দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ পাওয়া গিয়েছিল ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। সেই আদেশে বলা হয়েছিল: ইংরেজিতে থাকা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নামফলক, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনানুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছিল আদালত। আগেও আমরা এমন নির্দেশনা দেখেছিলাম। কিন্তু যে দেশে আড্ডা বা চায়ের দোকানে বসে নিজের যোগ্যতা প্রকাশ করতে যার যা সাধ্যমতো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করাটা নিত্য-নৈমিত্ত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, খাবারের বা কাপড়ের দোকানের নাম হয় ইংরেজি বা অন্য ভাষায়, সেলুনের নাম হয় অন্য ভাষায়; সে দেশে সেই আদেশ কতোটা কীভাবে কাজে লাগবে তা ভাবনার বিষয়।
সারা বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটি; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা মিলিয়ে ১২ কোটি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির সংখ্যা কম-বেশি এক থেকে দেড় কোটি। এই বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী নিয়ে একটি ভাষার টিকে থাকা অত্যন্ত সংগত ও ইতিবাচক। যেখানে শত শত ভাষা নিজস্ব ভাষী হারিয়ে বিপন্নতার মুখোমুখি, সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার সর্বত্র। এত অর্জনের পরও আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর জন্য মূলত দায়ী আমরাই।
বক্তৃতা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। ব্যক্তিত্বের বিকাশ, নিজের চিন্তাধারার সম্প্রসারণ, স্বীয় আদর্শ, চেতনা ও আবেগ প্রকাশ করার জন্য বক্তৃতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যারা বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা এখনো দিচ্ছেন তাদের বক্তৃতা শুনেই মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে, জীবন বিলিয়ে দিয়েছে বা এখনো দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। দেশ, জাতি ও মানবতার বৃহৎ কল্যানে আত্মনিয়োগ, সুন্দর, স্বপ্নময় ও কাক্সিক্ষত সমাজ গঠন করার লক্ষ্যেই নিজেকে সুবক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। আর এরজন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজনশুদ্ধ ভাষা চর্চার উদ্যোগ। বিশেষ করে যখন কোন জন সমাবেশে কথা বলতে হয় তার জন্য যতোটুকু সম্ভব শুদ্ধ ও সাবলীল উচ্চারণ অনুশীলন করে নেয়া খুব দরকার।
যখন একজন বিদেশি বাংলায় কথা বলে, দেখা যায় বিদেশি সুন্দর ও সাবলীল ভাবে বাংলা বলে। তখন ইংরেজি বা অন্য কোন ভাষার কোন ছোঁয়া থাকে না। আর আমরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার সময় বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে বলি। এতে ভাষার উজ্জ্বলতা ও প্রাঞ্জলতা নষ্ট হয়ে যায়।
একথা সত্য যে, বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে যোগাযোগের উপায় হিসেবে ইংরেজি ভাষার স্থান সবার ওপরে। ইংরেজি না জানলে ভালো কর্মসংস্থান হতো না, এই প্রচলিত প্রথাটা এখনো বহাল আছে, যদিও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি কম জানলেও তেমন কোনো সমস্যা নেই তবে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জানাটা দরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সব কার্যক্রম ইংরেজি ভাষাতেই চলে।
বাংলা ভাষাকে আজ জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি দেশের সরকারপ্রধানও বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের এই সাধের ও প্রাণের ভাষা নিজ ভূমিতেই কতটা যে অবহেলার স্বীকার, তার নজির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তক খুললে শিশুদের জন্য ভুল বানান আর ভুল বাক্যের ছড়াছড়ি দেখতে পাই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অধিকাংশ শিক্ষকেরই নেই প্রমিত বাংলা উচ্চারণদক্ষতা। ফলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদ্যাপীঠ থেকে ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানানে মাতৃভাষা শিখছে। উপরন্তু মহাবিপদ হয়ে উঠেছে হিন্দি ভাষার সিরিয়াল এবং হিন্দিতে ডাবিং করা কার্টুন ও অন্য অনুষ্ঠানগুলো। শহরের বাংলাভাষী অনেক মা-বাবাই আজ ঘরে শিশুর ইংরেজি কথোপকথন দক্ষতা বাড়াতে অনবরত ইংরেজি বলে যাচ্ছেন। তাই এই শিশুর কাছে আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল হয়ে উঠেছে জ্যাকফ্রুট। আজ বাংলা ভাষা এফএম বেতার ও টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রভাবে হিন্দি-উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে একটি মিশ্র ভাষারূপ অর্জনের পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়।
বাংলা ভাষার সাহিত্যসম্ভার পাঠ করে আজও আমরা আবেগাক্রান্ত হই, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ ভাষা এখন সংগ্রহশালা আর গবেষণার ভাষা। শত বছর পর বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ভেবে তাই আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। শহুরে তরুণ প্রজন্মের মুখের ভাষায় বিস্মিত না হয়ে উপায় কী! তারা যেন বাংলা ‘র’ ধ্বনিটি ভুলেই গেছে। তার জায়গায় প্রিয় হয়ে উঠেছে ‘ড়’। দেশি ফলের গন্ধ ও স্বাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ম্যাঙ্গো ফ্লেভার’। ইংরেজি নাম ছাড়া যেন মুখে স্বাদ লাগে না। আমাদের অহেতুক বিদেশি ভাষাপ্রীতির কারণে আজ বাংলা নামের খাদ্য মানেই অখাদ্য যেন। সরকারি অফিস-আদালত, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ সবখানেই বাংলা হরফে ইংরেজি অথবা ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা। ক্রমাগত বাড়ছে এই প্রবণতা। টিভি নাটক, চলচ্চিত্রের নামকরণেও আজ ইংরেজির আধিপত্য। আমাদের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিরা কি এগুলো নিয়ে ভাবছেন? ভবিষ্যতের বাংলা ভাষার জন্য কি কিছুই করণীয় নেই? এ দেশে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন হচ্ছে, অথচ বাংলা ভাষায় যে যথেচ্ছচার চলছে, তা দেখার কেউ নেই।
আমাদের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসটাকে পুঁজি করেও বিদেশি শব্দের প্রবেশ ঘটছে বাংলা ভাষায়। কওমি মাদ্রাসাসহ দেশের অনেক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উর্দু ভাষাকে সম্ভ্রান্ত ভাষা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। দেশের বিশিষ্ট আলেম বা ওলামারা নিজেকে যোগ্যতর হিসেবে প্রকাশ করার জন্য ধর্মীয় সমাবেশগুলোতে উর্দুতে বয়ান করেন। এই কৌশলটা তারা নিয়ে থাকেন নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে প্রকাশ করার জন্য। দেশের ধর্মীয় আলেম ওলামাদের এ রকমভাবে ধর্মীয় রীতি-নীতি বয়ান করলে সাধারণ মানুষ কতটা বোঝে এ নিয়েই সংশয় তো থেকেই যায়।
শিক্ষকতা হচ্ছে একটি শিল্প। এ শিল্পকে তিল তিল করে গড়ে তুলতে হবে শিক্ষককেই। শিল্প সৃষ্টির অন্যতম উপাদান হচ্ছে বিস্ময়বোধ। অর্থাৎ জীবনের গভীর অনুভূতিময় সত্তাকে উপলব্ধি করা শিক্ষণ শিল্পকর্মের এক বিশেষ অবলম্বন। তাই ভাষার সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যসাধন এবং সম্পাদনের জন্য আবেগের লালন ও পরিচর্যা প্রয়োজন। শিক্ষকের পাঠদানের ভাষা ও উপস্থাপন এমন হবে যাতে শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণে উন্মুক্ত হয়ে উঠে। উপযুক্ত ও আকর্ষণীয় সূচনা শিক্ষার্থীকে অনেকটা অগ্রসর করে তোলে। পাঠ্যবস্তু অবশ্যই মান ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে। ছাত্রদের কাছে যে শব্দগুলি একেবারেই অপরিচিত সেগুলো বুঝানোর জন্য আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার শ্রেণিকক্ষে যত কম হয় ততই ভাল। শ্রেণিকক্ষেই ছাত্র-ছাত্রীদের কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণ দোষ, জিহবার আড়ষ্টতা এবং পাঠের অন্যান্য দোষ-ত্র“টির সংশোধন ও পরিমার্জনের সুযোগ ঘটে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পাঠের সময় যাতে কোনো শব্দের অশুদ্ধ উচ্চারণ না করে শিক্ষক সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। পদ্যের পাঠের সময় শিক্ষক নিজে প্রথমে পাঠ করে শোনাবেন। তারপর ছাত্রকে পাঠ করতে বলবেন এবং উচ্চারণে ত্র“টি হলে শিক্ষক তা শুধরে দেবেন। নিজে বার বার উচ্চারণ করে শব্দটিকে শেখাবেন। শিক্ষককে একথা সব সময় মনে রাখতে হবে যে পাঠদানের ভাষা ও বলার ভঙ্গির উপর নির্ভর করেই পাঠ্য বিষয়টি জীবন্ত হয়ে উঠে। একজন শিক্ষককে অবশ্যই শ্রেণিকক্ষে আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করে বিশুদ্ধ চলিত ভাষায় কথা বলতে হবে। পাঠ গ্রহণের কাজটি যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে একঘেঁয়ে ও ক্লান্তিকর না হয় সে দিকটিও শিক্ষককে খেয়াল রাখতে হবে।
ইংরেজি বা অন্যকোন ভাষায় কথা বলতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ইংরেজি বলার সময় বাংলা আর বাংলা বলার সময় ইংরেজি সেটা পরিত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ শুদ্ধ বাংলা চর্চা করতে হবে। তবেই বাঙালি হব এবং ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া স্বার্থক হবে।