আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

268

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন-রাজপথে বাংলার ছাত্র জনতার দৃপ্ত মিছিল। হাজারো কণ্ঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে এমন দেশ পৃথিবীতে হয়ত আর একটি নেই। যা ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই বাংলায়। উত্তাল আন্দোলনে পাকিস্তান বাহিনীর বুলেট বিদ্ধ রফিক শফিক জব্বারসহ নাম জানা অজানা অনেক শহীদ হয়েছিলেন। বুলেটের প্রতিবাদে শাণিত কণ্ঠে সেদিন গেয়ে উঠেছিলেন গণসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল লতিফ, গেয়েছিলেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়!’। এই কালজয়ী গান এখনও মানুষের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন ও আহমদ রফিক রচিত ‘ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, একাধিক ভাষা বা সম্প্রদায় অধ্যুষিত দেশ বিশেষ কোন সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক স্বার্থের অসম বিকাশ, তা কোন কারণেই হোক না কেন, অনুন্নত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়া না করে পারে না। আর সেই প্রতিক্রিয়ার টানে ওই জাতি বা সম্প্রদায় সেই অসমতা দূর করার বা তাদের অবস্থা পরিবর্তনের ইচ্ছায় যে কোন রাজনৈতিক পন্থা গ্রহণ করতে পারে। বাংলাভাষার সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের শেকড় ছোঁয়া সম্পর্কের বিষয়টি প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে বিবেচনায় আসে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের শিক্ষিত অংশ বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। উর্দুকে তারা চেয়েছিলেন মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা হিসেবে। বাংলা উর্দু আরবীর মধ্য থেকে বাঙালি জাতি তাদের আত্ম অন্বেষণ শুরু করেন। কায়েদা আজম জিন্নাহ যখন ঢাকা সফরে এসেছিলেন তখন তার এই সফর শুধু সফরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলেন। সেদিন তার বক্তৃতায় তিনটি কাথা উল্লেখ করেন। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, কম্যুনিস্ট ও বিদেশী চরদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্ররক্ষার প্রয়োজনে সতর্কতা থাকতে হবে। অন্যটি হলো লীগের বিরোদ্ধে চরম হুঁশিয়ারি। এই কথাগুলো বলে তিনি গণতন্ত্রের কবর রচনা করে চলে গেলেন।
বদরুদ্দীন উমর ভাষা সৈনিক গাজীউল হককে নিয়ে লিখেছেন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেয়ার জন্য রাজনৈতিকভাবে যারা পরিচিত তার মধ্যে গাজীউল হক একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। ১৯৫২ সালে তিনি কোন রাজনৈতিক দল অথবা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত না থাকলেও তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুকে অবলম্বন করে যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও তৎপরতা চলত তার সঙ্গে নিজ জেলা বগুড়া ও পরে ঢাকায়, সম্পর্কিত থাকার কারণে তিনি ছাত্র ও রাজনৈতিক মহলে পরিচিত ছিলেন। পরে তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও ভাল পরিচয় হলেও ১৯৫২ সালে সে রকম কিছু ছিল না। আমি তখন অবশ্য তাকে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে জানতাম।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে যাদের সামান্য পরিচয় আছে তারা জানেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত আমতলায় যে বিখ্যাত ছাত্র জমায়েত হয়েছিল তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন গাজীউল হক। কিভাবে তিনি ওই জমায়েতে সভাপতিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সেটা তার নিজের জবানিতে আমি বলব তার পত্র উদ্ধৃত করে। কিন্তু তার আগে বলা দরকার, আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় যখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখার কাজ শুরু করি তখন সেই আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করি তার সাক্ষাতকার নেয়া এবং তার কাছে কিছু কাগজপত্র থাকলে সংগ্রহের জন্য, যাতে আমি সেগুলো দলিল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। এতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য পিছিয়ে গেলেও ছাত্রদের দৃঢ়তায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা অনেকে শহীদ হন। এরপর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলন। ছাত্রদের প্রবল প্রত্যাশার মুখে ক্ষমতালিপ্সু পাকিস্তানীদের হিসাব-নিকাশের রাজনীতি উড়ে গিয়েছিল সেদিন। রক্তের বিনিময়ে বাঙালী পেয়েছিল মাতৃভাষা বাংলাকে। এ কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির চির প্রেরণার প্রতীক।