ই-মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় আসছে সরকারী প্রাইমারী স্কুল

42

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মান্ধাতা আমলের অকার্যকর, অনিয়মিত বিদ্যালয় মনিটরিং ব্যবস্থার পরিবর্তে ই-মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় আসছে সারাদেশের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইতোমধ্যেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এখন থেকে প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে যেমন অফিসে বসে কর্মকর্তারা দায়সারা পরিদর্শন রিপোর্ট দিতে পারবেন না তেমনি শিক্ষকরাও শ্রেণীকক্ষে অনিয়মিত হতে পারবেন না। ই-মনিটরিং সিস্টেম পরিদর্শক একটি ডিভাইস সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ে যাবেন। কেন্দ্রীয় সার্ভারে তথ্য আপলোড করবেন। সঙ্গে সঙ্গেই প্রাথমিক শিক্ষার সকল বিভাগ তা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবে।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণই ই-মনিটরিং স্কুল সিস্টেম চালুর মূল লক্ষ্য বলে বলছে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ই-মনিটরিং সিস্টেমে কাজ করতে গিয়ে তারা কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির মুখে পড়ছেন। মাঠ পর্যায়ে তথ্য এনে সার্ভারে আপ করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সমস্যা হচ্ছে বলেও বলছেন তারা। বিষয়গুলো ইতোমধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে জানানো হয়েছে। অধিদফতর বলছে, যেহেতু প্রথম দিকের কাজ চলছে তাই সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ছে। শীঘ্রই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ উদ্যোগ পুরোপুরি বাস্থবায়ন করতে পারলে সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা মনিটরিং ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর মনিটরিং হলে সারাদেশেই প্রাথমিক শিক্ষার মানেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।
জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্য পূরণে ই-মনিটরিং সিস্টেম নামে এ ব্যবস্থার প্রণয়ন করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও সেভ দ্য চিলড্রেন। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মতে, কাগজভিত্তিক স্কুল মনিটরিং সিস্টেমটি স্কুল পর্যবেক্ষণ চিত্রকে যথাযথ প্রতিফলিত করে না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন (এমএ্যান্ডই) বিভাগে সরবরাহ করার আগে বিভিন্ন স্তর থেকে পর্যবেক্ষণ তথ্য একাধিকবার সমন্বয় করা হয়। এর ফলে কোন বিদ্যালয়ের মূল অবস্থার বিস্তারিত তথ্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় নথি ঘেটে পরিদর্শন প্রতিবেদন বের করতে হয় কর্মকর্তাদের। এ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। তাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও সেভ দ্য চিলড্রেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ডিজিটাল করতে ই-মনিটরিং ব্যবস্থার উদ্ভাবন ও চালু করেছে।
২০১৫ সালে গাজীপুর ও মানিকগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ই-মনিটরিং সিস্টেম চালু হয়। পরে ২০১৬-১৮ পর্যন্ত আরও ৮০টি উপজেলায় ই-মনিটরিং ছড়িয়ে দেয়া হয়। মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য ৬৪ জেলা থেকে তৈরি করা হয়েছে মাস্টার ট্রেনার।
এ ছাড়া ২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকা মেট্রোপলিটনের ১২ থানার শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের ঘোষণার মাধ্যমে ২০১৮ সালের মে মাসে এসব থানা পেপারলেস মনিটরিং এলাকায় পরিণত হয়।
সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশব্যাপী কাগজবিহীন স্কুল পরিদর্শন ব্যবস্থা ই-মনিটরিং বাস্তবায়নে অধিদফতর ৩৭২০টি ট্যাব কিনেছে। ই-মনিটরিং কাজে ব্যবহারের জন্য অক্টোবর-নবেম্বরে দেশব্যাপী মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে তা বিতরণ করা হয়। চলতি মাসেই ৬৪ জেলায় ই-মনিটরিং কার্যক্রম সম্প্রসারিত ও বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এ কার্যক্রম সময় ও পেপার ওয়ার্ক কমিয়েছে। এর ফলে শিক্ষাবিষয়ক নীতি নির্ধারকরা আরও সহজে অগ্রাধিকার শনাক্ত করতে পারবেন। শিক্ষা বিভাগের কর্মক্ষমতা, নিরীক্ষণ এবং কার্যকরভাবে নির্দিষ্ট কাজের ফল মূল্যায়নে সাহায্য করবে ই-মনিটরিং।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক ইন্দু ভূষণ দেব তাদের কার্যক্রমের বিষয়ে বলছিলেন, এটা সরকারের একটি বড় পদক্ষেপ। এটা ভালভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রতিমুহূর্তে তথ্য পাচ্ছি। উদ্যোগের সুফল সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন শুরু করেছেন কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে যেমন অফিসে বসে দায়সারা পরিদর্শন রিপোর্ট আর দেয়া যাবে না তেমনি শিক্ষকরাও শ্রেণীকক্ষে অনিয়মিত হতে পারবেন না। ই-মনিটরিং সিস্টেম পরিদর্শক বিদ্যালয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় সার্ভারে তথ্য আপলোড করবেন।
উদ্যোগের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হাসান উদ্যোগের কারণ ব্যাখ্যা করে বলছিলেন, সারা দেশের প্রায় ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় মনিটরিং করা জটিল কাজ। এ জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এ কারণে ই-মনিটরিং পদ্ধতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা যে তথ্যছক ব্যবহার করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করেন তার ওপর ভিত্তি করেই এ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক ই-মনিটরিং সিস্টেম চালু করেছে সেভ দ্য চিলড্রেনের আইসিটি টিম।
তিনি বলেন, স্কুল পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ এবং পর্যবেক্ষণের গুণগত ও পরিমাণগত তথ্য ওয়েবভিত্তিক ড্যাশবোর্ডে আপলোড করা হবে। ফলে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা স্মার্টফোন বা ট্যাব ব্যবহার করে বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণের তাৎক্ষণিক তথ্য (রিয়েল টাইম ডাটা) সংগ্রহ করতে পারবেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাদের উদ্যোগের বিষয়ে বলেছেন, আগে ম্যানুয়ালি পরিদর্শন ছিল। একটি ফরমে তথ্য সংগ্রহ করতে হতো। কিন্তু দেখা যেত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মকর্তা স্কুলে না গিয়েই নিজ অফিসে বসে প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠাতেন। এর ফলে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠানগুলো মনিটরিঙের বাইরেই থেকে যেত। কিন্তু এখন তাকে অবশ্যই বিপোর্ট করতে হলে একটি ডিভাইস নিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে তথ্য সার্ভারে তথ্য আপলোডের সঙ্গে সঙ্গে সরকারী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ তা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবে। ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম থেকে শিক্ষা কর্মকর্তারা দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পাবেন। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য পাব। লাইভেও আমরা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখতে পাব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ ই-মনিটরিং। এর মাধ্যমে সফটওয়্যার টুলস ব্যবহার করে বিদ্যালয় পরিদর্শন করা হবে। এ টুলস এ্যান্ড্রয়েড এপ্লিকেশন হিসেবে গুগল প্লেস্টোরে পাওয়া যাবে। এ ব্যবস্থা সফলভাবে বাস্তবায়ন ও সুবিধার জন্য ট্যাবলেট (ইলেকট্রিক ডিভাইজ) ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে ই-মনিটরিং সিস্টেম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ই-মনিটরিং ব্যবস্থায় স্কুলের কর্মদক্ষতা অগ্রগতি ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তথ্য ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করবে।
ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরির কার্যক্রম চলছে : সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৩ হাজার ৬৮৯টি ল্যাপটপ এবং ২২ হাজারের বেশি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর বিতরণ করা হয়েছে। চলতি শিক্ষা বর্ষেই প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল ডিভাইস বিতরণ করা হবে। ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরিতে এসব কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।