বিদায়ী বছরে গোলাপগঞ্জে ৮ হত্যাকান্ড

29

সেলিম হাসান কাওছার গোলাপগঞ্জ থেকে :
বিদায়ী ২০১৮ সালে গোলাপগঞ্জে যে কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে আলোচিত হত্যাকান্ডের ঘটনাও কম নয়। অনেক হত্যাকান্ডে রয়েছে রহস্যে ঘেরা। নানা কারণেই বছরটি ছিল উপজেলাবাসীর কাছে আলোচিত সমালোচিত। এ বছরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রত্যাশি আমির ও ব্যবসায়ী মুহিবুর হত্যাকান্ডের ঘটনা। রহস্যেয় ঘেরা ছিল খুন হওয়া অজ্ঞাত যুবতী নারীর লাশের। এ ঘটনার এখনও কোন ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এ বছরে যারা খুন হলেন… দিনমজুর আছবার, গৃহবধূ শাম্পু, এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রত্যাশি আমির, কৃষক আতিকুর, মাদক ব্যবসায়ী লিপন, ব্যবসায়ী মুহিবুর, দিন মজুর আজমল আলী ও অজ্ঞাত যুবতী।
২৫ ফেব্র“য়ারী : পূর্ব শত্র“তার যেরে আছবার আহমদ (১৭) নামে এক দিনমজুর খুন হয়। সে উপজেলার শরিফগঞ্জ ইউপির উজান মেহেরপুর গ্রামের এনাম উদ্দিনের ছেলে। ঘটনার দিন রাতে নিহত আছবার স্থানীয় কাদিপুর ফেরাই শাহ মাজারে ওরসের গানে অংশগ্রহণ করে। রাত ১টায় খুনিরা তাকে গান থেকে ডেকে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায়। তার চিৎকার শুনে মাজারের লোকজন এগিয়ে এলে খুনিরা পালায়। পরে মাজারের লোকজন স্থানীয়দের সহযোগিতায় আছবারকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ জানায়, পূর্ব বিরোধের জেরেই খুন করা হয় ঐ দিনমজুরকে। ২৬ ফেব্র“য়ারী নিহতের বাবা এনাম উদ্দিন বাদী হয়ে গ্রেফতারকৃত এনাম উদ্দিনকে প্রধান আসামী ও লিটন মিয়া (৩০) কে ২য় আসামী এবং অজ্ঞাত ৬/৭জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
১১ এপ্রিল : গোলাপগঞ্জে সুমি বেগম শাম্পু (৩৫) নামে এক গৃহবধূ খুন হন। সে গোলাপগঞ্জ পৌরসভার দাঁড়িপাতন গ্রামের (তেতইউলির) রিপন মিয়ার স্ত্রী ছিল। ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় দাঁড়িপাতন খালেরপার গ্রামের তেতইউলি বাড়ীতে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন বিকালে নিহতের আপন চাচা ও চাচাতো ভাইসহ অন্যান্য সহযোগীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নিহতের পরিবারে হামলা চালায়। তাদের হামলায় গুরুতর আঘাপ্রাপ্ত নিহত সুমি শাম্পু বেগমকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় নিহতের আপন দুই চাচিকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনার অনেক আসামীরা পলাতক রয়েছে।
১৮ এপ্রিল : এক বছর পূর্বের ক্যারাম খেলা নিয়ে গোলাপগঞ্জে আমির হোসেন (১৮) নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী খুন হয়। সে উপজেলার শরিফগঞ্জ ইউপির বসন্তপুর গ্রামের আব্দুল হকের পুত্র ও ফেঞ্চুগঞ্জ মানিককোনা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রত্যাশী ছিল। নিহত আমির প্রতিদিনের ন্যায় স্থানীয় সবন্তপুর বাজারে বাজার করতে গেলে একই এলাকার খুনিরা তাকে ডেকে সিরাজ উদ্দিন মার্কেটের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরপরই খুনিরা কোন কিছু বুজে উঠার আগেই দেশীয় ছুরা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপাতে থাকে। খুনিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিহত আমির হোসের প্রায় অর্ধ কিলোমিটার জায়গা দৌড়ায়। ঘাতকরাও দৌড়ে তার পিছু নেয় এবং সেখানে গিয়েও এলোপাতাড়ি কোপ দেয়। পরে স্থানীয়রা নিহত আমিরকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে তাৎক্ষণিকতাকে সিলেট ওসমানীতে নিয়ে যাওয়া হলে রাত অনুমান ১০টায় সেখানকার ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের মা পারভিন বেগম (৪০) বাদী হয়ে ১৫জনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে নিহতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় এলাকাবাসী বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেন।
১৪ জুন : মানসিক রোগীর হাতে আতিকুর রহমান (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ খুন হন। ওই মানসিক রোগী নিহতের আপন চাচাতো ভাই। নিহত ব্যক্তি ওই ইউনিয়নের রানাপিং সৎখন্ড গ্রামের মৃত আসাব উদ্দিনের ছেলে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় নিহত আতিকুর রহমান রানাপিং বাজারের একটি মার্কেটের সামনে বসা ছিলেন। এ সময় জহিরুল ইসলাম দা দিয়ে আতিকুর রহমানের মাথায় কয়েকটি কোপ দিলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় ওই বৃদ্ধার চিৎকার শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে হামলাকারি পালিয়ে যায় এবং আতিকুর রহমানকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু ঘটে। স্থানীয়রা জানান, খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি কিছুটা মানসিক রোগী ছিলেন।
৩১ জুলাই : স্থানীয়দের গণপিটুনিতে লিপন চন্দ্র দেব (৩৫) নামে এক মাদক ব্যবসায়ী খুন হয়। সে উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ দত্তরাইল নোয়াপাড়া গ্রামের মৃত নগেন্দ্র চন্দ্রের ছেলে। ঘটনার দিন উপজেলার দত্তরাইল নোয়াপাড়া গ্রামের লালমতি রুহি দাশের ভূমি দখল করতে নিহত লিপন দেশীয় অস্ত্র ধারালো দা (বটি) দিয়ে হামলা চালায়। সংবাদ পেয়ে গোলাগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে লিপন চন্দ্র দেব ও তার স্ত্রী পুলিশের উপরও হামলা চালায় এবং কাচের বোতল ও পাথর দিয়ে ঢিল মারতে থাকে। পরে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে লিপন চন্দ্র দেবকে গণ পিটুনি দিলে গুরুতর আহত হয় এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় নিহতেন মা হেপি রাণী দেব (৬০) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৫০০ লোককে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
৮ অক্টোবর : পাগল প্রায় শালিকাকে বিয়ে না করায় নিজ শ^াশুড়ির হাতেই মুহিবুর রহমান মোল্লা (৫২) নামে এক ব্যক্তি খুন হন। তিনি কানাইঘাট উপজেলার গোরকপুর গ্রামের ফয়জুর রহমানের পুত্র ছিলে। ৮ অক্টোবর সকালে উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের দক্ষিণ বাঘার শেষ সীমানায় হবিব মেম্বারের বাড়ির পাশে ব্রিজের নিচে পানিতে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত ওই রক্তমাখা লাশটি ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের পর পরিচয় না পাওয়া সিলেটের মানিক পীরের টিলায় দাফন সম্পন্ন করে। পরে ওই লাশের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অজ্ঞাতনামা ওই লাশের পরিচয় পাওয়া যায়। এ ঘটনায় নিহতের শ^াশুড়িসহ বেশ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তাদের রিমান্ডে আনা হলে তারা খুনের দায় স্বীকার করে। ঘটনার দিন রাত ১টায় কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মুহিবুরকে একটি সিএনজিতে বসিয়ে গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে বাঘা এলাকায় ফেলে যায় খুনিরা। আর এই খুনে নেতৃত্ব দেন নিহতের আপন শ^াশুড়ি। ঘটনার প্রায় ১ বছর পূর্বে নিহতের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে নিহতের শ^াশুর পাগল প্রায় মেয়েকে তার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় মুহিবুরকে হত্যা করা হয়।
৩ নভেম্বর : নিখোঁজ হওয়ার ৪ দিন পর আজমল আলী (৫৫) নামে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির খুন হওয়া লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে উপজেলার ভাদেশর ইউপির মাইজভাগ গ্রামের মৃত আছাব আলীর পুত্র। ওইদিন দিন সকাল ১০টায় তার বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি পুকুরে দু-পা বাঁধা অবস্থায় লাশ দেখতে পায় স্থানীয় লোকজন। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হলে পুলিশ ওই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। এ খুনের ঘটনায় নিহতের ছেলেরা জড়িত ছিল বলে জানা যায়। ওই লাশ উদ্ধারের পরবর্তী কোন খবর পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
৮ নভেম্বর : ঢাকাদক্ষিণ লেচুবাগান থেকে ২৫ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক যুবতীর নারীর হাত-পা বাঁধা গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিন উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউপির রায়গড় লেচুবাগান নাহিদ মিয়ার বাড়ীর টিলার পাশে হাত-পা বাঁধা গলাকাটা ওই যুবতী মহিলার লাশটি পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের পর সিলেট মানিক পীরের টিলায় দাফন সম্পন্ন করে। ওই লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দরুল ইমলাম বিপ্লব ওরফে বাবু (২৮) নামে একজনকে আটক করে পুলিশ। সে গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউপির দক্ষিণ রায়গড় গ্রামের আলাউদ্দিন মিয়ার ছেলে।