বিজয় দিবস ও ঐক্য

140

কামাল লোহানী

স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে চূড়ান্ত ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ দিয়েছিলেন, তাতেই ছিল আহ্বান ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে’, ‘ঘরে ঘরে দুগর্ গড়ে তোল’ কিংবা পাড়ায় মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন। যারা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতকর্ করেন, তাদের কাছে একটি প্রশ্ন উপরোক্ত নিদের্শগুলো বঙ্গবন্ধু তাহলে কেন দিয়েছিলেন?
বিজয় দিবস ও ঐক্য
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রক্তক্ষয়ী বিজয়ে বিপুল আনন্দে উদ্বেলিত বিশাল বাংলার তাবৎ মানুষ। ধর্ম-বর্ণ দলমত নির্বিশেষে যে জনগোষ্ঠী প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তির আকাক্সক্ষায় তারাই তো আজ বিজয়ের আনন্দযজ্ঞে প্রবল উল্লাসে উদ্ভাসিত। কিন্তু আমি যদি ৪৭ বছর আগের এই দিনটির কথা একবার স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনি, তাহলে আজ কেমন বিজয়কে আবাহন জানাচ্ছি, তা উপলব্ধি করব।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিজয় দিবসে লাখো শহীদের বিপুল রক্ত খরচে পাওয়া মুক্তির আনন্দ আমাদের শোকার্ত মনকে নতুন সম্ভাবনার আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল। স্বজনহারানো বেদনার্ত মানুষ সেদিন এই বাংলাজুড়ে, একদিকে শোক মানুষকে দিয়েছে দুঃখ তবু যেন বাংলা আপামর জনগণের আত্মত্যাগ, পরিবেশকে উদ্বেলিত করে তুলেছিল। কিন্তু আজ চার দশক পরে বাংলার অমিততেজা মানুষের মনে হতাশা আর বিভ্রান্তির অন্ধকার কেন? আজ কেন সেই যোদ্ধা বাংলার সাহসী মানুষ কোথায়? কেন লড়াকু বাংলার অকুতোভয় মানুষের ঐক্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে?
কেন যে আমরা দেশটাকে স্বাধীন ও সাবেভৗর্ম ভুখন্ডে পরিণত করলেও সবর্ক্ষণ উৎপীড়িত সেই একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির আস্ফালনে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমপর্ণে আমোদিত এই বাংলা কেন এত তাড়াতাড়ি ওদেরই চক্রান্তে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মদদে কুটিল, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত পরিবেশের নিকষ কালো আঁধারের কুশলী চক্রান্তে জড়িয়ে পড়ল। তবে কি আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয়কেই নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে সমুদ্রে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দৃঢ়তা, মুক্তি সেনাদের আত্মোৎসর্গ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো মার্কিনদের দস্যুবৃত্তি থেকে রহিত করেছিল। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতাই নয়, নানান চক্রান্তের হোতা ছিল, বাংলাদেশ শত্র“মুক্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সেই মার্কিন পরাশক্তিই নতুন রাষ্ট্রের কাঁধে চেপে বসেছিল রাজনৈতিক কৌশলের দুর্বলতায়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্তস্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন বটে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে দেশ গড়ার কাজে সঙ্গে পেলেন না। মাত্র সাড়ে তিনবছর পরে তাকে মার্কিন চক্রান্তেই খোন্দকার মুশতাক আহমদ ও দোসরদের হাতে হত্যা হতে হলো। বিশ্বাসঘাতক সেনা অফিসারদের একটি চক্র ক্রমেই ঘোঁট পাকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সচেতন দেশবাসী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল লড়াকু কৃষক শ্রমিক ছাত্রজনতার ঐক্য ওই চক্রান্তকে রুখে দিতে না পারলেও প্রতিবাদে তারাই সেদিন সোচ্চার হয়েছিলেন।
কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করার সাধ্য ছিল না কারো। তবে সেই মহান বিজয়কে কালিমালিপ্ত করতে ওই ষড়যন্ত্রকারীচক্র নানা কৌশলে স্বাধীন-সাবভৌর্ম বাংলাদেশকে পরপদানত করতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিল। তাই তো দেখি ইতিহাসের বিতর্কিত অংশের নায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তানপন্থি ও তাদের দোসর-দালাল, কসাই-জল্লাদদের মুক্তিসংগ্রামী বাংলার মানুষের বুকে তাজা খুনে রঞ্জিত মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। শুধু কি তাই, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এই জিয়াই তো পাকিস্তানি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ ‘সোয়াত’ খালাস করতে গিয়েছিলেন। তারপর ইতিহাসের পরিণতি জানতে পেরে তিনি লোকজন নিয়ে প্রাণভয়ে পাশের দেশে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উদ্বিগ্ন মুক্তিসংগ্রামী সাধারণ গ্রামবাসীরা তাকে আটকে দিয়েছিলেন। সেখানেই কালের প্রয়োজনে চট্টগ্রাম কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ গিয়ে পৌঁছলেন এবং তাকে বেতারে নিয়ে সেনাবাহিনীর বাঙালি জোয়ানদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আহ্বান জানালেন। প্রথমে তিনি রাজি হননি। হতেও চাননি। বেলাল মোহাম্মদের পীড়াপিড়িতে অবশেষে সম্মত হলেন এবং চট্টগ্রাম এলেন বটে কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র যারা পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেদিন বিশ্বের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ করে সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাদেরও মেজর জিয়া আটক করে ফেললেন প্রথমেই। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। কিন্তু ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে সন্ধ্যায় নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন বেতারে। এ সম্প্রচার বেশি দূর পৌঁছায়নি বলে অনেকেই শুনতে পাননি। চট্টগ্রাম ও আশপাশের মানুষ এই ঘোষণা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং একজন শিল্পপতি ও ফিল্ড মাশার্ল আইয়ুব খানের মন্ত্রী শুনে মন্তব্য করেছিলেন, এটা তো সামরিক অভ্যুত্থান নয়, এটি একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ।
শুধু তাই নয়, বেতারের বিদ্রোহী কর্মী ও সুধীজন তখনও যারা এই বিপ্লবী বেতার উদ্যোগে জড়িত ছিলেন, তারাও মেজর জিয়াকে বোঝালেন এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের প্রতি এই চরম মুহূতের্ বাংলার মানুষের লড়াইয়ের পক্ষে থাকার জন্য অনুরোধ জানালেন। মেজর জিয়া ছাড়া অন্য কোনো সেনা অফিসার তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। যা হোক, অনুরোধ তিনি রাখলেন বটে, তবে ঘোষণাটি তৈরি করতে সময় নিলেন অনেক। পরদিন ২৭ মাচর্ দুপুরে মেজর জিয়া যে ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন তার মমার্র্থ ছিল ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান, আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ এই পাঠ সেদিন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল ওই বিপ্লবী বেতার থেকে এবং সব বাঙালি জোয়ান, অফিসার একটা দিকনিদের্শনা পেয়েছিলেন। দেশবাসী বাংলার মানুষ বিপুল শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এই জেনে, বাংলার মানুষের মধ্যে যারা সেনাবাহিনীতে আছেন, তারাও এই চরমযুদ্ধে লিপ্ত।
স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মাচর্ রেসকোসর্ ময়দানে যে চূড়ান্ত ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ দিয়েছিলেন, তাতেই ছিল আহ্বান ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে’ ‘ঘরে দুগর্ গড়ে তোল’ কিংবা পাড়ায় মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন। যারা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতকর্ করেন, তাদের কাছে একটি প্রশ্ন উপরোক্ত নিদের্শগুলো বঙ্গবন্ধু তাহলে কেন দিয়েছিলেন?
কিংবা হঠাৎ করে একজন সেনা অফিসার তাও মেজর ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ করেন কোন যোগ্যতায়? তিনি কি কোনো রাজনীতি বা রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলেন? রাজনীতি অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া কি যে কোনো ব্যক্তিই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন? মুক্তিসংগ্রাম দীঘির্দনের। সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিই হলো মুক্তিযুদ্ধ। সুতরাং যার কোনো পটভূমিই নেই রাজনীতিতে তিনি কি করে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক অথবা স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন? এই অবাস্তব প্রসঙ্গটি তুলে দেশের সরলপ্রাণ মানুষকেই শুধু বিভ্রান্ত করা হচ্ছে না, উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অপরাধমূলক বৈষম্য ও বিভাজনের সৃষ্টি করা হচ্ছে নিরন্তর।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। একটি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের সুখময় পরিণতি এই ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস। কিন্তু এই বিজয় অজের্ন আমরা যাদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলাম তারাই হলো আজ বিজয়ী ভূমির অপশক্তি। যাদের দাপটে বিজয়ী জাতির গবির্ত নাগরিকরা নিশ্চুপ অবমাননার শিকারে পরিণত হয়েছে। বিজয় মানুষকে দিয়েছিল নতুন সম্ভাবনা মহতি ইশারা। পেয়েছিলাম সব মানুষ জীবনজয়ের অপূণর্ শক্তি। তাকে নস্যাতের উদ্ভট ও নৃশংস চক্রান্ত শুরু হয়েছিল ওই বিজয়ের মহান দিনটি থেকেই। আর বিজয়ী জাতির গৌরবের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খাবি খাচ্ছে সেই উচ্ছ্বসিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। কারণ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জামায়াত-শিবির। তারা দেশের অভ্যন্তরে এমনকি আন্তজাির্তক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে হতমান করার নিমর্ম অপপ্রয়াসে লবিং সৃষ্টি করে চলেছে। ওদের আধিক্যে যেমন দেশটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক শক্তির বিভাজনে দেশটা কলুষিত হয়ে গেছে। এই নিমর্ম নিষ্ঠুুর আঘাতকে চ্যালেঞ্জ করে আমাদের যে উঠে দাঁড়াতে হবে, সে কথাই যেন আমরা ভুলে গেছি। এ ভুল ভেঙে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না, সক্রিয় হয়ে মাতৃভূমির ঋণ পরিশোধে অটুট ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, এই হোক এই বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।